সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে দুদকের মামলায় গ্রেফতারের তিন বছর পর রবিবার মধ্যরাতে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন নির্দোষ পাটকল শ্রমিক জাহালম ওরফে জানে আলম (২৮)। কারাগারের ফটক থেকে মুক্ত ভাইকে সঙ্গে নিয়ে রাতেই টাঙ্গাইলের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন জাহালমের ভাই শাহনুর।

কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এর সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা জানান, এ কারাগারে বন্দি জাহালম ওরফে জানে আলমকে হাইকোর্টের নির্দেশে রবিবার রাত ১২ টা ৫০ মিনিটের দিকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর আগে আদালতের দেওয়া তাকে মুক্তির আদেশ মহাকারা পরিদর্শকের দপ্তরের মাধ্যমে রাত ১২ টা ৫মিনিটের দিকে কাশিমপুরের এ কারাগারে পৌছে। পরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রবিবার জাহালমকে মুক্তির ওই আদেশ দেন। টাকা জালিয়াতির অভিযোগে দুদকের দুদকের মামলায় তাকে গত ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করা হয়। এরপর ওই বছরের (২০১৬ সালের) ২৭ মে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে এ কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। তিনি টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানার ধুবরিয়া এলাকার ইউসুফ আলীর ছেলে। জাহালম ওরফে জানে আলম পেশায় পাটকল শ্রমিক। কারাগার থেকে মুক্তির সময় তার ভাই শাহনুর মিয়া কারা ফটকে উপস্থিত ছিলেন।

জানা গেছে, সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেক নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের অভিযোগের চিঠি পেয়ে প্রায় ৫ বছর আগে দুদক কার্যালয়ে হাজির হয়ে নিজেকে জাহালম বলে দাবী করে বলেছিলেন, তিনি মামলার আসামী সালেক নন। এসময় জাহালম তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবী করেন। কিন্তু সেদিন নিরীহ পাটকল শ্রমিক জাহালমের কথা দুদকের কেউ বিশ্বাস করেন নি। দুদকের ভুলের কারণে ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আসামী সালেকের বদলে গ্রেফতার হন জাহালম। এরপর দুদকের ওইসব মামলায় সালেকের বদলে তিন বছর কারাগারে বন্দি জীবন কাটাতে হয়েছে টাঙ্গাইলের নির্দোষ জাহালমকে। কারাবন্দি জাহালম বহুবার আদালতে হাজিরা দিলেও তার জামিন মিলে নি। ইতোমধ্যে দুদকের ৩৩টি মামলার মধ্যে ২৬টি মামলায় জাহালমকে আসামি আবু সালেক হিসেবে চিহ্নিত করে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। এসব মামলায় বিচারিক আদালতে বিচার শুরু হয়।

দুদকের মামলায় প্রকৃত আসামী আবু সালেকের স্থলে নির্দোষ শ্রমিক জাহালম কারাগারে বন্দি থাকার বিষয়ে গত ৩০ জানুয়ারি বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত। পরে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করে। এরপর আদালত রবিবার জাহালমকে দুদকের ২৬ মামলা থেকে অব্যাহতির আদেশ দিয়ে বলেন, কোনো নির্দোষ ব্যক্তিকে এক মিনিটও কারাগারে রাখার পক্ষে আমরা না। জাহালমের কারাগারের মেয়াদ এক দিন বাড়বে, তো আপনার (দুদক) ওপর কমপেনসেশন (ক্ষতিপূরণ) বাড়বে। কমপেনসেশন করতে হবে। দুদক করেন বা ব্যাংক করেন। আদালতের আদেশের প্রেক্ষিতে রবিবার রাতে কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন জাহালম ওরফে জানে আলম। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর কারা ফটক থেকে জাহালমকে সঙ্গে নিয়ে তার ভাই শাহনুর মিয়া রাতেই টাঙ্গাইলের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন।

গত বছর দুদকের নজরে আসে জাহালম ওরফে জানে আলম দুদকের মামলার প্রকৃত আসামি আবু সালেক নন। মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকেও বিষয়টি জানানো হয়। তখন দুদকের অধিকতর তদন্ত উঠে আসে জাহালম নির্দোষ। আসল আসামী আবু সালেকের ঠিকানা খুঁজে বের করা হয়। তখন দুদকের পক্ষ থেকে জাহালমের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য বিচারিক আদালতে আবেদন করা হয়। দুদকের অধিকতর তদন্তে জাহালমের নির্দোষ বিষয়টি জানার পরই দুদকের পিপিরা জাহালমের জামিনে কোনো আপত্তি করেননি। ইতোমধ্যে চারটি মামলা থেকে জাহালমের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়েছে।

দুদকের মামলায় প্রকৃত আসামী আবু সালেকের স্থলে নির্দোষ শ্রমিক জাহালম কারাগারে বন্দি থাকার বিষয়ে গত ৩০ জানুয়ারি বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত। পরে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করে। জাহালমের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, জানতে চাওয়া হয় রুলে। সেই সঙ্গে ‘ভুল আসামির’ কারাগারে থাকার ব্যাখ্যা জানতে দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি, মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তা, স্বরাষ্ট্র সচিবের প্রতিনিধি ও আইন সচিবের প্রতিনিধিকে তলব করে তাদেরকে রবিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টায় সশরীরে আদালতে হাজির থাকার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

এরই ধারাবাহিকতায় রবিবার দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি হিসেবে দুদকের মহাপরিচালক (তদন্ত), মামলার বাদী আব্দুল্লাহ আল জাহিদ, স্বরাষ্ট্র সচিবের (সুরক্ষা) প্রতিনিধি যুগ্ম সচিব সৈয়দ বেলাল হোসেন এবং আইন সচিবের প্রতিনিধি সৈয়দ মুশফিকুল ইসলাম আদালতে হাজির হন।

আদালতে শুনানির শুরুতে দুদক চেয়ারম্যানের পক্ষে আদালতে বক্তব্য দেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। এসময় তিনি আদালতকে জানান, সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তথ্য পাওয়ার পর দুদক আবু সালেকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। দুদক কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ্ আল জাহিদ মামলার তদন্ত করেন। তার অভিযোগপত্রে জাহালমের নাম উঠে আসে। টাঙ্গাইলের স্থানীয় চেয়ারম্যানরা জাহালমকে সনাক্ত করেন। জাহালমের বিরুদ্ধে ২৬টি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। পরে এসব মামলায় বিচারিক আদালতে বিচার শুরু হয়। তবে গত বছর দুদকের নজরে আসে জাহালম মামলার প্রকৃত আসামি আবু সালেক নন। মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকেও বিষয়টি জানানো হয়। তখন দুদকের অধিকতর তদন্ত উঠে আসে জাহালম নির্দোষ। আসল আসামী আবু সালেকের ঠিকানা খুঁজে বের করা হয়। তখন দুদকের পক্ষ থেকে জাহালমের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য বিচারিক আদালতে আবেদন করা হয়। দুদকের অধিকতর তদন্তে জাহালমের নির্দোষ বিষয়টি জানার পরই দুদকের পিপিরা জাহালমের জামিনে কোনো আপত্তি করেননি। ইতোমধ্যে চারটি মামলা থেকে জাহালমের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়েছে।

আদালতের বিচারক উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশের জন্য দুদকের মত একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুদক যদি প্রোপারলি কাজ না করে তাহলে আমাদের যে উন্নয়ন হচ্ছে তার স্থায়ীত্ব থাকবে না। দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করুক এটা আমরাও চাই। মনে রাখতে হবে এটি একটি স্বাধীন দেশ।

এরপর আদালত জাহালমকে দুদকের ২৬ মামলা থেকে অব্যাহতির আদেশ দিয়ে বলেন, কোনো নির্দোষ ব্যক্তিকে এক মিনিটও কারাগারে রাখার পক্ষে আমরা না। জাহালমের কারাগারের মেয়াদ এক দিন বাড়বে, তো আপনার (দুদক) ওপর কমপেনসেশন (ক্ষতিপূরণ) বাড়বে। কমপেনসেশন করতে হবে। দুদক করেন বা ব্যাংক করেন।

শুনানির শেষ পর্যায়ে আদালতে উপস্থিত এক উপকারামহাপরিদর্শকে আদালত বলেন, আপনারা আজই জাহালমকে রিলিজ করে দেবেন। দুদক এর খরচ দেবে।