আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি, পার্বত্য শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি ও ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষায় ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন যে দাবি জানিয়ে আসছে, তা একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদেই পূরণ করা যাবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।

ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইইডি) আয়োজিত আদিবাসী বাঙালি সাংস্কৃতিক উৎসব’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসে তিনি বলেন, আমরা এই পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এসেছি। এই পার্লামেন্টেই আদিবাসি বিতর্কের অবসান হবে।১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য শান্তি চুক্তির মূল বিষয়ের অনেকগুলোই যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়নি বলে পাহাড়ে এখনও ভূমি বিরোধ চলছে বলে মনে করেন মেনন।

গত সরকারে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে আসা এই নেতা বলেন,এই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের পর পাহাড়ে বাঙালি অনুপ্রবেশ, তাদের অভিবাসন বন্ধ করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, একদিনেই সব সমস্যার সমাধান হবে না। শুধু দেশই নয়, বাইরের অনেক শক্তিও এতে জড়িত। চুক্তি বাস্তবায়নে তাই ধৈর্য্য ধরতে হবে।

শনিবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় ‘সকল জাতিসত্তার মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার চাই’ প্রতিপাদ্যে আয়োজিত হয় এই উৎসব।

উৎসবের প্রতিপাদ্য প্রসঙ্গে রাশেদ খান মেনন বলেন, “১৯১০ সালের শিক্ষা নীতিতে বলা হয়েছিল, সকল জাতিসত্তার মানুষদের তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার দিতে হবে। এরপর আদিবাসিদের ভাষা ও বর্ণমালা নিয়ে নানা বিতর্ক হয়েছে। নানা সময়ে বাংলা, রোমানসহ নানা হরফে আদিবাসিদের ভাষা লেখার চেষ্টা করা হয়েছে।“চাকমা ও ত্রিপুরা ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা থাকলেও তাতে পাঠ্যপুস্তক কিভাবে প্রণয়ন করা হবে, তা নিয়ে আদিবাসিদের মধ্যেই গ্র“প তৈরি হয়ে গেল। তাই জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের বিষয়টি কাজে আসছে না।

নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় রচিত ও সুরারোপিত গানগুলো এখন বাংলাতেও অনূদিত হয়েছে।মেনন মনে করেন, বাঙালির মূল সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটাতে এই অনুবাদ প্রক্রিয়া কাজে দেবে।

ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় উত্তরবঙ্গে বসবাসরত সাঁওতালদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার কথা স্বীকার করে নেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেণ।তিনি বলেন, এই দ্বন্দ্বের কারণে আদিবাসীদের অনেক উৎসব জাতীয় পর্যায়ে রূপদান করা যাচ্ছে না। আদিবাসীদের সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়েছে অপসংস্কৃতি।

আদিবাসী পরিষদ নিজ উদ্যোগে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকাগুলোর স্কুলে ১৯৯৮ সাল থেকে বাংলার পাশাপাশি তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় পাঠদান প্রক্রিয়া শুরু করে। এখন এতে বিভিন্ন এনজিও সহযোগিতা করছে। নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে গেলে হরফের প্রশ্নে বিতর্ক উঠতে পারে এমন আশঙ্কাও করছে আদিবাসী পরিষদ।সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের গন্ডি ছাপিয়ে উপমহাদেশীয় হরফ ও বানান রীতি অনুসরণ করা যেতে পারে বলে মনে করেন রবীন্দ্রনাথ সরেণ।

১৯২৫ সালে পন্ডিত রঘুনাথ মূর্মূ সাওতালদের জন্য অলচিকি বর্ণমালার প্রবর্তন করেন। সেই বর্ণমালায় ভারতের উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গেও পাঠ্যপুস্তক রচনা কাজ চলছে, যা পরে রাজ্য সরকারও অনুমোদন দেয়।বাংলাদেশেও অনুরূপ পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে বলে মত দেন আদিবাসী পরিষদের সভাপতি।চল্লিশ বছর ধরে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব বর্ণমালায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ণের দাবি জানিয়ে চলছে সাংস্কৃতি আন্দোলন, যার পুরোভাগে রয়েছেন নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ।

তিনি বলেন, আদিবাসীদের প্রি স্কুলগুলোতে নিজস্ব ভাষায় পাঠদান হচ্ছে। কিন্তু সেটা খুব ফলপ্রসু হবে না। সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে এখন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনেও রূপ দিতে হবে।অনুষ্ঠানে আলোচনায় যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মুহম্মদ সামাদ, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবু নাসের খান, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি জিয়াউদ্দিন তারিক আলী, আদিবাসী নেতা বিচিত্রা তিরকি।