একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য দেশের মানুষের কাছে ‘ক্ষমা না চাওয়ায়’ জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগ করেছেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, যিনি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে শীর্ষ জামায়াত নেতাদের আইনজীবী দলের নেতৃত্বে ছিলেন।

সময়ের দাবিতে সাড়া দিয়ে ‘বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের আওতায় ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে’ জামায়াতকে একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থতা নিয়েও পদত্যাগপত্রে হতাশা প্রকাশ করেছেন তিনি।রাজ্জাকের বড় ছেলে ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিকী জানান, শুক্রবার জামায়াতের আমির মকবুল আহমদকে ওই পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন তার বাবা।

জামায়াতের একজন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল বলেছেন, ঢাকায় তাদের আমিরের কাছে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের পদত্যাগপত্র আসার কথা তিনিও জানতে পেরেছেন।আব্দুর রাজ্জাকের ব্যক্তিগত সহকারী কাউসার হামিদ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক দুটি কারণ উল্লেখ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগ করেছেন।

জামায়াত ৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার জন্য জগণের কাছে ক্ষমা চায়নি এবং একবিংশ শতাব্দির বস্তবতার আলোকে এবং অন্যান্য মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বিবেচনায় এনে নিজেদের সংস্কার করতে পারেনি।লন্ডনে আইন পড়া রাজ্জাক ১৯৮৬ সালে দেশে ফিরে অ্যাডভোকেট হিসেবে এনরোলমেন্ট নেন। ওই সময় থেকেই তিনি জামাডাতে ইসলামীর রাজনীতিতে সক্রিয় হন।

তবে আইনজীবী হিসেবে রাজ্জাকের নাম আলোচনায় আসে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর। ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলে তাদের প্রধান আইনজীবী হিসেবে আদালতে দাঁড়ান রাজ্জাক।

জ্যেষ্ঠ বদরনেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির ৫ দিন পর ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রাজ্জাক ঢাকা ছাড়েন। ব্রিটিশ নাগরিকত্বধারী এই আইনজীবী সেখান থেকেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন।

এসেক্সের বারকিং থেকে ঢাকায় পাঠানো ওই পদত্যাগপত্রে রাজ্জাক জামায়াতের আমিরকে পরম শ্রদ্ধেয় মকবুল ভাই’ সম্বোধন করে লিখেছেন, একাত্তরে মুক্তিদ্ধের বিরোধিতা পরবর্তীকালে জামায়াতের সকল সাফল্য ও অর্জন ম্লান করে দিয়েছে।রাজ্জাক লিখেছেন, গত প্রায় দুই দশক তিনি জামায়াতকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা ও পাকিস্তান সমর্থনের কারণ উল্লেখ করে জাতির কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাওয়া উচিত।

আমি সব সময় বিশ্বাস করেছি এবং এখনও করি যে, ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে নেতিবাচক ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া শুধু নৈতিক দায়িত্বই নয় বরং তৎপরবর্তী প্রজন্মকে দায়মুক্ত করার জন্য অত্যন্ত জরুরি কর্তব্য।

জামায়াতে ইসলামীর সূচনা হয় উপমহাদেশের বিতর্কিত ধর্মীয় রাজনীতিক আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালের ২৬ অগাস্ট, তখন এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ।পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর মুসলিম পারিবারিক আইনের বিরোধিতা করায় ১৯৬৪ সালে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলেও পরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন ১১ দফাসহ বিভিন্ন দাবির বিরোধিতা করে জামায়াত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ নামে বিভিন্ন দল গঠন করে জামায়াত ও এর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ। সে সময় তারা সারা দেশে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের মত যুদ্ধাপরাধ ঘটায়। সেই অপরাধে সর্বোচ্চ আদালতে এ পর্যন্ত জামায়াতের সাত শীর্ষ নেতার সাজা হয়েছে, তাদের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে।

১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের মতো ধর্মাশ্রয়ী দলগুলো নিষিদ্ধ হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান তাদের রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ করে দেন। আর জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যুদ্ধাপরাধী দুই জামায়াত নেতাকে দেন মন্ত্রিত্ব।একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করে আদালতের একটি রায়ে বলা হয়, দেশের কোনো সংস্থার শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের থাকা উচিত নয়।

শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় উচ্চ আদালতের নির্দেশ নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে। ব্যক্তির পাশাপাশি দল হিসেবে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আইনি কাঠামো তৈরির কাজ করছে সরকার। রাজ্জাক তার পদত্যাগপত্রে লিখেছেন, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে শীর্ষ জামায়াত নেতাদের মামলা তিনি ‘সততা ও একাগ্রতার সঙ্গেই’ পরিচালনা করেছেন।আবার আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন, একাত্তরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উপলব্ধি ও মুক্তির আকঙ্খার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল বলে মনে করেন তিনি।

যে কোনো রাজনৈতিক দল, ইতিহাসের কোনো এক পর্বে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ত্রুটি-বিচ্যুতির শিকার হতে পারে। কিন্তু তাকে ক্রামাগত অস্বীকার করে, সেই সিদ্ধান্ত ও তার ফলাফল মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অনড় অবস্থান বজায় রাখা শুধু অগ্রহণযোগ্যই নয় বরং আত্মঘাতী রাজনীতি। তা কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।রাজ্জাক লিখেছেন, একাত্তরের ভূমিকার জন্য গ্রহণযোগ্য বক্তব্য প্রদানের ব্যর্থতা এবং ক্ষমা না চাওয়ার দায়ভার এখন তাদেরও নিতে হচ্ছে, যারা তখন ওই সিদ্ধান্তের সঙ্গে জড়িত ছিল না, এমনকি যাদের তখন জন্মও হয়নি।এই ক্রমাগত ব্যর্থতা জামায়াতকে স্বাধীনতাবিরোধী দল হিসাবে আখ্যায়িত করার ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করছে। ফলে জামায়াত জনগণ, গণরাজনীতি এবং দেশ বিমুখ দলে পরিণত হয়েছে।

দলীয় ফোরামে কবে কখন কীভাবে তিনি এ বিষয়ে যুক্তি দিয়েছেন, তার একটি তালিকা পদত্যাগপত্রে তুলে ধরেছেন এই আইনজীবী।

তিনি লিখেছেন, সবশেষে, ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর জানুয়ারী মাসে জামায়াতের করণীয় সম্পর্কে আমার মতামত চাওয়া হয়। আমি যুদ্ধকালীন জামায়াতের ভূমিকা সম্পর্কে দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিই। অন্য কোন বিকল্প না পেয়ে বলেছিলাম, জামায়াত বিলুপ্ত করে দিন।কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আমার তিন দশকের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।১৯৮৬ সালে জামায়াতে যোগ দেওয়ার পর দলের ভেতর থেকেই সংস্কারের চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জানিয়ে রাজ্জাক লিখেছেন, দলের কাঠামোগত সংস্কার, নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং জামায়াতের উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা ও কর্মসূচিতে ‘আমূল পরিবর্তন’ আনতে তার তার প্রস্তাবগুলো গত ৩০ বছরে ইতিবাচক সাড়া পায়নি।

কয়েকটি দেশে ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে গঠিত মধ্যমপন্থি দলগুলো সফলতা অর্জন করেছে। এই পরিবর্তনের বাতাস যদিও এখনও বাংলাদেশের গায়ে লাগেনি, কিন্তু সময় এসেছে আমাদের পূর্বপুরুষের তৈরি ইসলামি রাষ্ট্রের ধারণায় কোনো পরিবর্তন আনা যায় কি না, তা নিয়ে নতুন প্রজন্মের গভীরভাবে চিন্তা করার।

পদত্যাগপত্রে রাজ্জাক বলেছেন, অতীতে অনেকবার পদত্যাগের কথা ভাবলেও তিনি নিজেকে বিরত রেখেছেন এই ভেবে যে দলের সংস্কার করা সম্ভব হলে এবং একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াত জাতির কাছে ক্ষমা চাইলে তা হবে একটি ঐতিহাসিক অর্জন।কিন্তু জানুয়ারি মাসে জামায়াতের সর্বশেষ পদক্ষেপ আমাকে হতাশ করেছে। তাই পদত্যাগ করতে বাধ্য হলাম। এখন থেকে আমি নিজস্ব পেশায় আত্মনিয়োগ করতে চাই। সেই সাথে ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি সমৃদ্ধশালী ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব।