ওয়াহেদ ম্যানসনের বেজমেন্টে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যালের সন্ধান পেয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। সেখানে শত শত বস্তা, প্লাস্টিকের ড্রাম আর টিনের মাঝারি সাইজের ড্রাম দেখতে পান তারা। এখানে আগুন লাগলে ভবনটি একেবারে উড়ে যেত বলে মন্তব্য করেন তারা।

শুক্রবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১১টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মরদেহের সন্ধান করতে গিয়ে ওয়াহেদ ম্যানসনের বেজমেন্টে এই দৃশ্য দেখতে পান তারা।

ওইসব বস্তা ও ড্রামে কী আছে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা গোডাউনে মজুদ করা বস্তা ও ড্রামগুলো থেকে নমুনা নিয়েছি। তাতে দেখা গেছে, আয়রন অক্সাইড, আয়রনিক ইয়ালো, ইঞ্জিনিয়ার কার্বন, অক্সাইড রেডবার ও এসিড গ্রিন রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো। কোনোভাবে আগুন নিচে গেলে এমনভাবে বিস্ফোরণ ঘটত যা বিল্ডিংটাকে উড়িয়ে নিয়ে যেত। তখন এই আগুন পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ত। কী ঘটতো ভাবতেই শরীর শিউরে উঠছে বলে জানান ফায়ারের এই কর্মকর্তা।

ফায়ারের আরেক কর্মকর্তা বলেন, আশেপাশের কয়েকটি ভবন উড়িয়ে দেওয়ার মতো দাহ্য পদার্থ ওয়াহেদ ম্যানসনের বেজমেন্টে মজুদ রয়েছে। আমরা সেটি সিলগালা করে রেখেছি। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) একেএম শাকিল নেওয়াজ শুক্রবার দুপুরে বলেন, ওয়াহেদ ম্যানসনের বেজমেন্টে বস্তা ও ড্রাম মজুদ দেখা গেছে। সেগুলো তদন্ত করা হচ্ছে।

আগুন ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কোথা থেকে আগুনের সুত্রপাত হয়েছে তা তদন্তের আগে বলা যাচ্ছে না। এখানে নানা কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কোথায় থেকে স্পার্ক হয়েছে এরপর তা কিভাবে দ্রুত ছড়িয়েছে তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। কারণ, এখানে দাহ্য পদার্থের শেষ নেই।

বেজমেন্টে যে কেমিক্যাল পাওয়া গেছে তার মালিক কে জানতে চাইলে শাকিল নেওয়াজ বলেন, মালিক কে এখনো জানা যায়নি। অনেকের কাছে শুনে ধারণা করা হচ্ছে, ওয়াহেদ ম্যানসনের দ্বিতীয় তলায় পারফিউমের মজুদ যার ছিল, নিচের মজুদও তারই। তবে তার নাম জানা যায়নি এখনো।

বেজমেন্টে আগুন না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে শাকিল নেওয়াজ বলেন, আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়ার পথটি ছিল পেছনের দিকে এবং সেটি ছিল বন্ধ। তাই অক্সিজেন ভেতরে যেতে পারেনি। অক্সিজেন না গেলে সেখানে আগুনও ছড়ায় না। যার কারণে সবকিছু অক্ষত আছে।

বেজমেন্টে কেমিক্যাল গোডাউন আছে তা এলাকার কেউই জানেন না বলে মত দেন এলাকাবাসী। ওপরে বোতলে গ্যাস ভরানো হয় সেটাই সবাই জানে। পুরান ঢাকায় গোপনে এরকম কত কেমিক্যাল গোডাউন আছে তা হয়ত কেউ জানেনই না বলে মন্তব্য করেন এলাকাবাসী।

বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান সৈয়দা রাজিয়া সুলতানা বলেন, আয়রণ অক্সাইড তেমন শক্তিশালী কেমিক্যাল না। বাকি তিনটি আয়রনিক ইয়ালো, ইঞ্জিনিয়ার কার্বন, অক্সাইড রেড বার ও এসিড গ্রিন মোটামুটি শক্তিশালী। তবে সবগুলো যদি একত্রিত হয় এবং আগুনের সংস্পর্শে আসে, তাহলে বড় ধরনের বিস্ফোরণ হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

ওয়াহেদ ম্যানশনে এখনো শতাধিক কনটেইনার রাসায়নিক পদার্থ মজুদ আছে। শুধু কনটেইনার নয়, শতাধিক ব্যাগভর্তি রাসায়নিক পদার্থ ও প্লাস্টিকের পণ্য তৈরির দানাও রয়েছে। যেগুলোর ন্যূনতম বিস্ফোরণে ওয়াহেদ ম্যানশনের মতো কয়েকটি ভবন উড়ে যেতে পারে।গত বুধবার রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওয়াহেদ ম্যানশন।

অগ্নিকান্ডে ৬৭ জন নিহতের ঘটনায় ‘ওয়াহেদ ম্যানশন’ ভবনে রাসায়নিক পদার্থ থাকার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তদন্ত কমিটি।

ওয়াহেদ ম্যানশনে শুক্রবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, ভবনটির নিচতলা থেকে শুরু করে প্রতিটি ফ্লোরই আগুনে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু নিচতলার একটি গোডাউনে এখনো প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক পদার্থ অক্ষত অবস্থায় মজুদ রয়ে গেছে।

শুধু ওয়াহেদ ম্যানশন নয়, এর আশপাশের ভবনগুলোতেও এভাবে রাসায়নিক পদার্থের মজুদ ও ব্যবসা করা হতো। মূলত যে কয়টি ভবন আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এসব ভবনের সবকটির নিচে রয়েছে প্লাস্টিকের দানা, বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের দোকান বা গোডাউন।

ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনের বিল্ডিংয়ের নিচতলায় থাকা একটি টেইলার্সের দর্জি শামসুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ওই দিন আমরা একটু আগেই দোকান বন্ধ করে চলে যাই। কারণ ২১ ফেব্রুয়ারি, কাস্টমারও তেমন আসবেন না। দোকান বন্ধ করে আগে চলে যাওয়ায় আমরা রক্ষা পাই।

পাশের কয়েকটি দোকান দেখিয়ে দিয়ে শামসুল বলেন, এগুলোতে প্লাস্টিকের দানা ও বিভিন্ন কেমিক্যাল বিক্রি হতো। এসব দোকানি প্রায় ৩০-৩৫ বছর এই এলাকায় ব্যবসা করে যাচ্ছেন।

আজ সকালে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন পরিদর্শন শেষে এক ব্রিফিংয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লে. কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান বলেন, ‘হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন’ ভবনে নিশ্চিতভাবেই রাসায়নিক পদার্থ ছিল। সেইসঙ্গে ওই ভবনে কোনো ধরনের অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল না।

২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ১২৪ জন মানুষের প্রাণহানির ৯ বছর পর সেই পুরান ঢাকাতেই ঠিক একই কারণে অগ্নিকা-ে ৭০ জন মানুষের প্রানহানি হয়েছে।