চট্টগ্রামের হাটহাজারী, রাউজান ও ফটিকছড়ি উপজেলার মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া দেশের একমাত্র মিঠা পানির কার্প জাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ) মা-মাছের প্রাকৃতিক মৎস প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর বুকে নিষিদ্ধ ইঞ্জিন চালিত নৌকা ও ড্রেজারের আনাগোনা বেড়েছে। মা-মাছের ডিম ছাড়ার আগাম সময়ে এসব ড্রেজার দিয়ে রাতের অন্ধকারে নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বালু উত্তোলনের পাশাপাশি ইঞ্জিন চালিত নৌকা দিয়ে দিবারাত্রি বালু পরিবহণ করে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে বিপন্ন হচ্ছে হালদা নদীর মৎস্যকুল। ধ্বংস হচ্ছে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার উপযোগি নদীর অমূল্য জীববৈচিত্র ও তাদের আবাসস্থল।

রাজনৈতিক পরিচয়ে গুটি কয়েক প্রভাবশালী হায়েনা এই ড্রেজার ব্যবহার করে প্রতিদিন লুটে নিচ্ছে কোটি টাকার সম্পদ। এতে করে হালদা নদী ক্রমেই ক্ষত-বিক্ষত হয়ে নদীর পরিবেশ মাছের প্রজননের প্রতিকূলে চলে যাচ্ছে। ফলে কার্প জাতীয় বিভিন্ন প্রজাতির মা-মাছের অবাধ বিচরণ ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি মা-মাছ মারা যাওয়াসহ নদীর পাড়, বসতঘর ও প্রতিষ্ঠান ভাঙনের মুখে পড়ছে। এছাড়া সরকার লাখ লাখ টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

কয়েকজন মৎস্যজীবি ক্ষোভ প্রকাশ অভিযোগ করে এ প্রতিবেদককে বলেন, নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে প্রশাসনের কর্তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রাতের অন্ধকারে ড্রেজার বসিয়ে নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে বালু তোলা হচ্ছে। বালু তোলার কারণে হালদার পাড় সংলগ্ন বিভিন্নস্থানের বসতঘর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নদী ভাঙনের মুখে পড়েছে। একইভাবে শুধুমাত্র বালু তোলার কারনে হালদা নদীর ৪০ কিলোমিটার জুড়ে দু‘তীরে নানা স্থানে ভাঙন চলছে। সরকার ভাঙন রোধে কোটি টাকা ঢাললেও বালু তোলা বন্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। স্থানীয় লোকজন প্রতিবাদ করলে তাকে এলাকা ছাড়া হতে হচ্ছে।

হালদা পাড়ের গড়দুয়ারা ইউনিয়নের বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ্ব মৎস্যজীবি কামাল সওদাগর এ প্রতিবেদককে জানান, নদীতে মা-মাছের ডিম ছাড়ার আগাম সময়ে ড্রেজার ও ইঞ্জিন চালিত নৌকা দেদারসে চলাচল করছে। শুধু তাই নয় এসব নৌকা ও ড্রেজারে করে রাতে ও দিনে সমানে বালু পরিবহণ করে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছে একটি সিন্ডিকেট। এতে করে ড্রেজারের আঘাতে মৎস্যসহ নানা প্রাণীকুলের প্রাণহানী ঘটছে। গত কয়েক দশক ধরে দখল দূষণের পাশাপাশি বর্তমানে ড্রেজারে বিপন্ন হালদা নদী। ইঞ্জিন চালিত নৌকায় ব্যবহৃত ড্রেজারের প্রপেলার আর বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত ড্রেজারে এ নদীর মৎস্যকুল ধ্বংসের পথে। মরে ভেসে উঠছে বিরল প্রজাতির ডলফিনও। হারিয়ে যাচ্ছে মূল্যহীন নানা জীববৈচিত্র।

শনিবার বিকাল ৩টায় ঘটনার সত্যতা জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা গবেষক ড. মো. মঞ্জুরুল কিবরিয়া জানান, আমি বর্তমানে হালদা নদীতে অবস্থান করছি। বালু উত্তোলন হালদার জন্য মারাত্মক হুমকি। তাছাড়া কার্প জাতীয় মা-মাছের ডিম ছাড়ার আগাম সময়ে হালদার বুকে নিষিদ্ধ ইঞ্জিন চালিত নৌকা ও ড্রেজারের আনগোনা শুভকর নয়। যদিও বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন তথা স্থানীয় ইউএনও রুহুল আমিন বেশ তৎপর। তবে হালদার ঐহিত্যকে ধরে রাখার জন্য প্রশাসনকে এ সময় থেকে আরো বেশি কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে।

দিবারাত্রি বালু তোলার বিষয়টির সত্যতা প্রকাশ করে ওই গবেষক আরও বলেন, বালু উত্তোলনের কারণে নদীর তলদেশের মাটির গঠন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, শব্দ দূষণ বাড়ছে, পানি ঘোলা হয়ে যাচ্ছে, সূর্যের আলো ঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে না, বালুর সঙ্গে সঙ্গে জলজ প্রাণিও উঠে আসছে। এতে জলজ জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব তো পড়ছেই, সেই সঙ্গে বালু তোলার ড্রেজারের আঘাতে প্রায়ই মারা যাচ্ছে অমূল্য জীববৈচিত্র্য। বালু উত্তোলন অব্যাহত থাকলে নদীর পরিবেশ মাছের প্রজননের প্রতিকূলে চলে যাবে। এছাড়া নদীপারের বসতঘর ও প্রতিষ্ঠান ভাঙনের মুখে পড়বে।