চট্টগ্রামের হালদা নদী শুধুই একটি নদী নয়, এটি একটি রূপালি সম্পদের খনি। কিন্তু কিছু লোভী, দুর্বৃত্ত, ভূমি দস্যু, মৎস্য শিকারী অবলীলায় হামলে পড়ছে বেচারা হালদার ওপর। তাইতো আজ এ হালদার এমন বেহাল দশা। দৈন্য দশা আর বিপর্যস্ত হচ্ছে এর অস্থিত্ব। বিপর্যস্ত হচ্ছে হালদার পরিবেশ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র।
হুমকির মুখে বিশ্বের অন্যতম একমাত্র মিঠা পানির কার্প জাতীয় (রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাইশ) মাছের প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদার মা-মাছের বিচরণ ক্ষেত্রেও। এর কান্না শোনার কেউ যেন নেই। প্রতিদিন হালদা নদীর কোথাও না কোথাও মরে ভেসে উঠছে মা-মাছ। ফলে চারপাশে ছড়াচ্ছে কটূ গন্ধ। মা-মাছের ডিম ছাড়ার আগাম সময়ে বিগত প্রায় ১ সপ্তাহ ধরে চলছে এ অবস্থা। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন সম্প্রতি নদীতে নিষিদ্ধ যান্ত্রিক যানের অত্যাচার বেড়েছে। এসব যান্ত্রিক যান (ইঞ্জিন চালিত নৌকা ও ড্রেজার) এর ডুবন্ত ঘুর্ণায়মান পাখার আঘাতে মা-মাছসহ নদীর মৎস্যকুলের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে চলেছে।
সেমাবার (৪ মার্চ) হালদা নদীর অংকুরী ঘোনা এলাকায় ১৪/১৫ কেজি ওজনের একটি কাতাল (মা-মাছ) মরে পঁচে ভেসে উঠে। মাছটি ভাসতে দেখলে স্থানীয় লোকজন ওই এলাকার ডিম সংগ্রহকারী উদয়ন বড়–য়াকে বিষয়টি অবহিত করে। তিনি (ডিম সংগ্রহকারী) ঘটনাস্থলে পৌঁছে মাছটি নদী থেকে উদ্ধার করে হাটহাজারী উপজেলা মৎস্য অফিসে নিয়ে আসে।
বিষয়টির ব্যাপারে জনতে চাইলে হাটহাজারী সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আজহারুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে এ প্রতিবেদককে জানান, দুপুর ২টার দিকে হালদা নদীর অংকুরী ঘোনা এলাকায় থেকে একটি মা-মাছ (কাতাল) উদ্ধার করে আমার অফিসে নিয়ে আসে। মাছটির ময়না তদন্তের জন্য আইডিএফ হালদা প্রকল্পের কর্মকর্তা সাদ্দাম হোসেন ও ডিম সংগ্রহকারী উদয়ন বড়–য়া দিয়ে আমি হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে দিয়েছি।
তিনি আরও জানান, মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত হালদা নদীতে সকল প্রকার যান্ত্রিক যান চলাচল বন্ধ রাখতে চলতি বছরের ৮ জানুয়ারী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মমিনুল হক পত্র মারফত বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও তীর সংরক্ষণ বেড়ি বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানানো হলেও তা মানা হচ্ছে না।
এছাড়া নদী পাড়ের লোকজনের অভিযোগ, মা-মাছের ডিম ছাড়ার আগাম সময়ে নদীতে হঠাৎ করে যান্ত্রিক যানের অত্যাচার বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব যান্ত্রিক যান দিয়ে রাতের অন্ধকারে নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বালু উত্তোলনের পাশাপাশি দিন-রাত বালু পরিবহন করে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে এসব ডুবন্ত ঘুর্ণায়মান পাখার আঘাতে নদীর মা-মাছসহ জলজ প্রাণি প্রতিনিয়ত মারা পড়ছে। অভিযোগকারীদের মতে এসব যান্ত্রিকযান নিয়ে নদী থেকে বালু উঠাচ্ছে যারা, তারা এলাকার প্রভাবশালী হওয়ার কারণে কেউ আইনের তোয়াক্কা করেন না।
এদিকে হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা গবেষক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া মুঠোফোনে এ প্রতিবেদককে জানান, সোমবার হালদা নদী থেকে মৃত দুইটি মাছ উদ্ধার করছে স্থানীয়রা। এরমধ্যে কার্প জাতীয় (কাতাল) মা-মাছটির ওজন হবে ১৪-১৫ কেজি। মাছটির মাথায় ও লেজে গুরুত্বর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। মাছটি প্রায় ৩ ফুট লম্বা। এছাড়া উদ্ধারকৃত অন্য আইড় মাছটির ওজন হবে ৩/৪ কেজি। ওই মাছটিরও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন দৃশ্যমান। ধারণা করছি, সম্প্রতি হালদার ভাঙন রোধে তীর সংরক্ষণ বেড়ি বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজে ব্যবহ্নত যান্ত্রিক যানের ডুবন্ত ঘুর্ণায়মান পাখার আঘাতে এ মাছটি মারা গেছে। তবে ময়না তদন্ত শেষে এসব মাছগুলোর মৃত্যু প্রকৃত কারণ উদঘাটন করা যাবে।