রাষ্ট্রপতি ও চীফ স্কাউট মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, স্কাউট আন্দোলন শিশু কিশোরদের চারিত্রিক গুণাবলী বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লেখাপড়ার পাশাপাশি সামাজিক বিভিন্ন কর্মকান্ডে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করার মানসিকতা তৈরীতে স্কাউটিংয়ের ভূমিকা অনন্য। স্কাউটরা নিয়মিত সমাজসেবামূলক কাজের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলা ও আর্তমানবতার সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে আরো সুন্দর করে গড়ে তুলতে স্কাউটরা রাখতে পারে অগ্রণী ভূমিকা। বিশেষ করে শিশু কিশোর ও যুবাদের মাদক, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িতকতা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিষবাষ্প থেকে নিরাপদ এবং দূরে রাখতে স্কাউটিং ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে। স্কাউটিংই পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আধুনিক, প্রগতিশীল, সৃজনশীল করে গড়ে তুলতে।

তিনি রবিবার গাজীপুরে কালিয়াকৈরের মৌচাকে জাতীয় স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ১০ম বাংলাদেশ ও ৩য় সানসো জাম্বুরীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন।

রাষ্ট্রপতি বলেন, বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করেছে। সরকারের যুগোপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে নি¤œ-মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। পেয়েছে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার স্বীকৃতি। উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে নতুন প্রজন্মকে দক্ষ ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের চলমান অগ্রযাত্রায় নেতৃত্বদানের জন্য আগামী প্রজন্মকে স্কাউটিংয়ের মাধ্যমে দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করতে আমি স্কাউট নেতৃবৃন্দের প্রতি আহবান জানাই।

তিনি স্কাউটদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করি, একজন স্কাউট লেখাপড়ায় যেমন ভাল, তেমনি সমাজে পরোপকারী ও স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সকলের ¯েœহ ও ভালবাসার পাওয়ার অধিকারী। তোমরা কঠোর পরিশ্রম ও অনুশীলনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিন জীবনে স্কাউট আদর্শের প্রতিফলন ঘটাবে এবং দেশের যে কোন প্রয়োজনে একজন প্রকৃত দেশপ্রতিস ও স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে আতœনিয়োগ করবে। নিরক্ষরতা, দারিদ্র, ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গঠনে তোমাদের রাখতে হবে রলিষ্ঠ ভূমিকা।

রাষ্ট্রপতি বলেন, স্কাউটরা নিয়মিত সমাজসেবামূলক কাজের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা ও আর্তমানবতার সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে। স্কাউটরা সৃষ্টিকর্তা ও দেশের প্রতি কর্তব্যপালন করতে এবং সর্বদা একে অপরকে সাহায্য করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে স্কাউট আন্দোলনে যোগদান করে। সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড, বৃক্ষরোপণ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ, জলবায়ূ উষ্ণতারোধে জনসচেতনতা তৈরী, বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, ভবনধ্বস ও অগ্নিকান্ডের ঘটনায় উদ্ধার কাজসহ জাতীয় দুর্যোগে স্কাউটরা সবার আগে এগিয়ে আসে।

স্কাউটদের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি বলেন, তোমাদের এ সেবাধর্মী কার্যক্রম ভবিষ্যতে আরো বিস্তৃতি লাভ করবে বলে আমি আশা করি। তোমাদের অবস্থান হবে মাদকের বিরুদ্ধে, সন্ত্রাস জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। অন্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশপ্রেমে দেশের মানুষের প্রতি কর্তব্য ও মমত্ববোধ সব সময় জাগ্রত রাখতে হবে। নিজেরা ভাল কাজ করবে এবং অন্যদেরকেও ভাল কাজে অংশগ্রহণের আহবান জানাবে। আগামী দিনে তোমরাই বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে। তোমরাই জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা দারিদ্রমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ করবে। এ জন্য তোমাদের যোগ্য ও দক্ষ হয়ে উঠতে হবে।

রাষ্ট্রপতি বলেন, স্কাউট জাম্বুরী শত বছরের রোভারিং চেতনাকে উজ্জীবিত করার পাশাপাশি দেশে রোভার স্কাউটিংয়ের সম্প্রসারণ, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সৌহার্দের বন্ধনকে আরো সৃদৃঢ় করতে সহায়ক হবে বলে আমার বিশ্বাস। বহিঃবিশ্বে স্কাউটদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে আমাদের স্কাউটরা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আরো অবদান রাখবে এটাই সকলের প্রত্যাশা।

আবদুল হামিদ বলেন, জাতীয় ও আর্ন্তুজাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ স্কাউটসের ব্যতিক্রমধর্মী কার্যক্রম আমাকে মুগ্ধ করেছে। সম্প্রতি চকবাজারে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে উদ্ধার কাজ ও দেশব্যাপী সড়ক নিরাপত্তা ও ট্রাফিক শৃঙখলা রক্ষায় সহায়তা করে বাংলাদেশ স্কাউটস উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশে স্কাউটসের সদস্য সংখা ২১ লক্ষে উন্নীত করা লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সাথে ২০২১ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হবে ৩২ তম এপিআর স্কাউট জাম্বুরী। সদস্য সংখ্য ক্রমাগত বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ বিশ^ স্কাউট সংস্থার টপফাউভ কান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড এবং এপিআর সাসটেনেবল গ্রোথ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করায় আমি স্কাউট সদস্যদের জানাই উষ্ঞ অভিনন্দন।

এর আগে রাষ্ট্রপতি স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এসে পৌঁছলে স্কাউট নেতৃবৃন্দ তাঁকে স্বাগত জানান। রাষ্ট্রপতিকে স্কাউট নেতৃবৃন্দ স্কাউটের স্কার্ফ, ব্যাচ, ওয়াগেল ও টুপি পরিয়ে দেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ স্কাউটসের সভাপতি মোঃ আবুল কালাম আজাদ, জাম্বুরী চিফ ও বাংলাদেশ স্কাউটসের প্রধান জাতীয় কমিশনার ড. মোঃ মোজাম্মেল হক খান, জাম্বুরী সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি আখতারুজ জামান খান কবির প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি ও চিফ স্কাউট স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত করেন। এরআগে তিনি পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে ১০ম বাংলাদেশ ও ৩য় সানসো জাম্বুরীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। পরে তিনি জাম্বুরীর তাঁবু এলাকা পরিদর্শন করেন।

উল্লেখ্য, গত ৮ মার্চ কালিয়াকৈরের মৌচাকে এবারের ১০ম বাংলাদেশ ও ৩য় সানসো জাম্বুরী শুরু হয়। আগামী ১৪ মার্চ পর্যন্ত ৭(সাত) দিন ব্যাপি এ জাম্বুরী অনুষ্ঠিত হবে। এবারের জাম্বুরীর থিম হচ্ছে ‘যোগ্য নেতৃত্ব উন্নত দেশ’। এবারের জাম্বুরীতে বাংলাদেশের সকল জেলা ও উপজেলা থেকে ১০২২ টি স্কাউট দলের দশ হাজার ৯৮ জন স্কাউট ও গার্ল ইন স্কাউট অংশগ্রহণ করেছেন। এছাড়াও ভারত (২৭৭), ভূটান (৮), মালদ্বীপ (২৩), আফগানিস্তান (২), শ্রীলঙ্কা (৭), নেপাল (৯৬), ব্রুনাই দারুস সালাম (১), ইংল্যান্ড (১) ও আমেরিকা (২) এই ৯টি দেশ থেকে এসেছেন ৪১৭ জন স্কাউট ছেলে-মেয়ে ও স্কাউট লিডার। এছাড়া ইন্ডিয়ার পশ্চিমবঙ্গ থেকে সুমিত মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের একটি স্কাউট লিডার প্রতিনিধি দল মোটরসাইকেল যোগে এসে জাম্বুরীতে যোগদান করেছেন। এরমধ্যে দু’জন গার্ল গাইডের সদস্যও রয়েছেন। এ জাম্বুরীতে বিশ্বস্কাউট সংস্থার সেক্রেটারী জেনারেল আহমেদ আলহেন্দাউই, এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনাল স্কাউটসের পরিচালক জে আর পাঙ্গিলিনান ও বয় স্কাউট অব আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মি. ড্যান ওনবে অংশ নিয়েছেন।

স্কাউটসের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ ও মার্কেটিং) মোঃ মশিউর রহমান জানান, এবারের ১০ম বাংলাদেশ ও ৩য় সানসো স্কাউট জাম্বুরীর মূল এরিনার নামকরণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নামে করা হয়েছে। বর্তমান প্রজন্মের নিকট বাঙালির জাতির পিতাকে পরিচিত করার জন্য এ নাম করণ করা হয়েছে। এছাড়াও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর চারজন ঘনিষ্ট সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান এর নামে ৪টি ভিলেজের নামকরণ করা হয়েছে। এ ৪টি ভিলেজের অধীনে ১২টি সাব ক্যাম্প থাকবে। এ সাব ক্যাম্পগুলো কবি, সাহিত্যিক ও বিশিষ্ট ব্যাক্তি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জসিম উদ্দিন, সুফিয়া কামাল, ইমরান নূর, জীবনানন্দ দাশ, এম মহবুবুজ্জামান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, হুমায়ুন আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক ও শামসুর রাহমানের নামে নামকরণ করা হয়েছে। এবারের জাম্বুরীকে মোট ১৪টি ভেঞ্চার ও কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানের সমন্বয়ে আকর্ষণীয়, উদ্দীপনামূলক, শিক্ষণীয় ও প্রতিযোগিতামূলক প্রোগ্রাম সাজানো হয়েছে, যা ভিলেজ, সাব ক্যাম্প ও কেন্দ্রীয়ভাবে বাস্তবায়িত হবে।