সব শ্রেণীর গ্রাহকের জন্য গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। প্রস্তাবনা অনুয়াযী, দুই বার্নাও চুলায় ১ হাজার ৪৪০ ও এক বার্নার চুলায় ১ হাজার ৩৫০ টাকা করার কথা বলা হয়েছে।

মঙ্গলবার (১২ মার্চ) টিসিবি (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) অডিটোরিয়ামে গণশুনানির শুরুতে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি গ্যাসের এই দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন।

এদিকে, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিরোধিতা করে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ‘কিছুদিন পর পর জ্বালানি পণ্য গ্যাসের দাম বৃদ্ধি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্থ করে। এতে উদ্যোক্তা তৈরি হবে না। পাশাপাশি গ্যাসের দাম বাড়লে মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তরা ক্ষতিগ্রস্থ হবেন।

এছাড়া নতুন গ্যাসসংযোগ পেতে বিড়ম্বনা, স্বল্পচাপে গ্যাস সরবরাহ, ইভিসি (ইলেকট্রিক ভলিউম কারেকটর) মিটারের ব্যবস্থা না করে গ্যাসের দাম বাড়াতে গণশুনানি করাকে হাস্যকর বলেও মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা।

গণশুনানির শুরুতে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করে। এতে সবচেয়ে বেশি সার উৎপাদনে ২১১ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম সিএনজিতে ৫০ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়। এছাড়া প্রস্তাবে বিদ্যুতে ঘনমিটার প্রতি গ্যাসের দাম ৩ দশমিক ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৭৪ টাকা, সিএনজিতে ৩২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৮ দশমিক ১০ টাকা, প্রি-পেইড মিটারে ৯ দশমিক ১০ (ঘনমিটার) টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ দশমিক ৪১ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়। এছাড়া আবাসিকে একচুলা বর্তমান দর ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩ শ ৫০ টাকা, দুই চুলা ৮ শ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪ শ ৪০ টাকা, সার উৎপাদনে ঘনমিটার প্রতি ২ দশমিক ৭১ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৪৪ টাকা, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৯ দশমিক ৬২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ দশমিক ০৪ টাকা, শিল্পে ৭ দশমিক ৭৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৪ দশমিক ০৫ টাকা, বাণিজ্যিকে ১৭ দশমিক ০৪ টাকার পরিবর্তে ২৪ দশমিক ০৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

কোম্পানিটি প্রথমে গড়ে ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব দিলেও পরে সংশোধিত প্রস্তাবে ১০২ দশমিক ৮৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করে। পাশাপাশি বর্তমান বিতরণ চার্জ ২৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে চলতি অর্থবছরে ৫৩ পয়সা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫৫ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়।

তিতাসের দামবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানিতে অংশ নিয়ে এফবিসিসিআই-এর সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন গ্যাসের দাম না বাড়ানোর আবেদন জানান। এসময় তিনি বলেন, সরকার অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু সরকারের স্বল্প মেয়াদী শিল্প উন্নয়ন নীতি অগোছালো। কিন্তু মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি উন্নয়ন নীতি বেশ ভালো।

তিনি আরও বলেন, শুধু দাম বাড়ানোর সময় আমাদের ডাকা হবে আর বিশ্ববাজারে দাম কমলে কমানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না, এটি ঠিক হয়। ২০১৯ সালে বিশ্বে গড় গ্যাসের দাম ছিল ৬ দশমিক ৯ ডলার। গত কয়েকবছরে মজুরি ও অন্যান্য ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে আমাদের ২৯ ভাগ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন আবার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেলে উদ্যোক্তারা দেওলিয়া হয়ে যাবে। এছাড়া নতুন শিল্প উদ্যোক্তা তৈরি হবে না। এতে কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্থ হবে।

বিজিএমইএ-এর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, সারাবিশ্বে তেলের দাম কমলেও বাংলাদেশে জ্বালানির দাম কমেনি। আবেদন করার পর শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সবেমাত্র গ্যাস সংযোগ পেতে শুরু করেছে। এখন এই দামবৃদ্ধি কার স্বার্থে করা হচ্ছে প্রশ্ন রেখে তিতাসের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা ৩৫ ভাগ লভ্যাংশ দিতে চাচ্ছেন কিন্তু আমরা তো দুই-তিন ভাগও ব্যবসা করতে পারছি না। এসময় তিনি গণশুনানিকে হাস্যকর বলে অভিহিত করেন।

বিটিএমএ-এর সভাপতি মোহম্মদ আলী খোকন বলেন, গার্মেন্টস শিল্প যে ৪০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করছে তার পেছনে আমাদের ১৭ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে। আপনারা বারবার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করছেন কিন্তু আমরা যে ইভিসি (ইলেকট্রিক ভলিউম কারেকটর) মিটার চাচ্ছি তা দুই থেকে তিন বছরেও দিতে পারেননি। ফলে গ্যাসের নিম্নচাপ, অপর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ, গ্যাসের প্রকৃত ব্যবহারের চেয়ে বিল বেশি দিতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এখন আবার গ্যাসের দাম বাড়লে শিল্প প্রতিষ্ঠানের চাবি বিইআরসির কাছে দিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না আমাদের।

ক্যাবের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলেন, আগামী এপ্রিলে এলএনজি আসতে পারবে না। এই বিষয়টি সরকার যেমন জানেন, বিইআরসিও তা বোঝে। কিন্তু তার পরেরও যে গ্যাস আসেইনি সে গ্যাসের ওপর ভিত্তি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে তা অযৌক্তক ও অন্যায়।’ এছাড়া তিনি বলেন, ‘জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলে সাত হাজার ৫০০ কোটি টাকা পড়ে রয়েছে।’ সরকার যতদিন অর্থ না দেয়, ততদিন সে তহবিল থেকে ঋণ দিয়ে এলএনজির ব্যয় নির্বাহের আহ্বান জানান তিনি। একই সঙ্গে গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাবটি বাতিলেরও দাবি জানান।

গণশুনানিতে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম, সদস্য মিজানুর রহমান, মাহমদুউল হক ভুইয়া, রহমান মুশেদ, আব্দুল আজিজ খান, বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও ক্যাবের প্রতিনিধিসহ অনেকে।