রূপালি সম্পদের খনি বলে খ্যাত দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে চলতি মাসের ১৭ থেকে ২১ এপ্রিল পূর্ণিমার সময় প্রবল বর্ষণ আর মেঘের গর্জনের সঙ্গে পাহাড়ি ঢল নামলেই মা-মাছের ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা আছে। তাইতো এ সময়ে বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাঁটার এ নদীতে কার্পজাতীয় জাতীয় (রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাউশ) মা-মাছের আনাগোনা যেমনটা বেড়েছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দিবারাত্রি চলাচল করছে নিষিদ্ধ যান্ত্রিক যান। ফলে বিপন্ন হচ্ছে হালদা নদীর মৎস্যকুল। এছাড়া ধ্বংস হচ্ছে নদীর জীববৈচিত্র্য, ব্যাহত হচ্ছে মা-মাছের অবাধ বিচরণ ও তাদের আবাসস্থল। প্রতিনিয়তই নদীর কোথাও না কোথাও মরে পঁচে ভেসে উঠছে মা-মাছসহ জলজপ্রাণী।

মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) সকালে হালদা নদীর খলিপার ঘোনা এলাকায় একটি মৃগেল (মা-মাছ) মরে পঁচে ভেসে ওঠে। মাছটি ভাসতে দেখলে স্থানীয় জনতা বিষয়টি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা গবেষক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া ও পিকেএসএফ এর আওতাধীন আইডিএফ (ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন) হালদা প্রকল্পের কর্তাদের অবহিত করে। পরে তারা মাছটি উদ্ধার করে হাটহাজরী উপজেলার গড়দুয়ারা ইউনিয়নের নয়াহাট এলাকায় মাটিতে ফুতে ফেলে।

বিষয়টির সত্যতা জানতে চাইলে হালদা গবেষক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া মুঠোফোনে এ প্রতিবেদককে জানান, মঙ্গলবার হালদা নদী থেকে একটি মৃত মৃগেল মাছ উদ্ধার করে স্থানীয়রা। কার্পজাতীয় (মৃগেল) ওই মা-মাছটির ওজন হবে প্রায় ৮ কেজি। দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ ফুট (৩৩ ইঞ্চি)। মাছটির শরীরে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। নদীতে যান্ত্রিক যানের পাখার আঘাতে এ মা-মাছটিসহ জলজ প্রাণী প্রতিনিয়ত নদীর মৎস্যকুল ও জীববৈচিত্র্য মারা পড়ছে বলে তিনি দাবী করেন।

তিনি আরও বলেন, বিশেষ করে সম্প্রতি হালদার ভাঙন রোধে তীর সংরক্ষণ বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত যান্ত্রিক যানের ডুবন্ত ঘূর্ণয়মান পাখার আঘাতে এসব মা-মাছ মারা যাচ্ছে। গত ৫ মার্চ ( সোমবার) হালদা নদী থেকে মৃত দুটি মাছ উদ্ধার করেছেন স্থানীয়রা। এর মধ্যে কার্পজাতীয় (কাতলা) মা-মাছটির ওজন ছিল প্রায় ১৫ কেজি। প্রায় ৩ ফুট লম্বা মাছটির মাথায় ও লেজে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন ছিল। এছাড়া একই দিনে উদ্ধারকৃত অন্য আইড় মাছটির ওজন হবে প্রায় ৩-৪ কেজি। ওই মাছটিরও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন দৃশ্যমান ছিল।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হাটহাজারী সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আজহারুল আলম বলেন, মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত হালদা নদীতে সব প্রকার যান্ত্রিক যান চলাচল বন্ধে গত ৮ জানুয়ারি পত্র দিয়ে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও তীর সংরক্ষণ বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানানো হয়। তবে তা অজ্ঞাত কারণে কেন মানা হচ্ছে না তা বোধগম্য নয়।

এদিকে উপজেলার দায়িত্বভার গ্রহনের পরপরেই হালদাকে গুরুত্ব দিয়ে নানা উদ্যোগ গ্রহন করেছে দাবী করেছেন হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ রুহুল আমীন। তিনি বলেন, ডিম সংগ্রহকারীরা যাতে রেকর্ড পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করতে পারেন এজন্য মা-মাছ সংরক্ষণের উপর জোর দিয়েছি। তাইতো আমি আইডিএফ হালদা প্রকল্পের কর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে হালদায় অবিরাম ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে মালামাল বোঝাইকারী নিষিদ্ধ ইঞ্জিন চালিত নৌকা, বালু খেকোদের ডেজার, মৎস্য দস্যুদের ভাসা- ঘেরা জাল জব্দ ও ধ্বংসসহ হালদার দূষণ কমানোর সাথে ডিম থেকে রেণু তৈরির কুয়াগুলো সংস্কার এবং নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ব্যবস্থার কাজ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা নিয়ে সম্পন্ন করেছি।

এছাড়া হালদার ভাঙন রোধে তীর সংরক্ষণ বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত যান্ত্রিক যানের চলাচল প্রায় ৯০ ভাগ বন্ধ হয়েছে এমনটা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, প্রশাসন তথা আমাদের চোখে ফাঁকি দিয়ে কিছু কিছু বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত যান্ত্রিক যানের চলাচল আমাদের কাছে দৃশ্যমান। তাইতো মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) দুপুরে গড়দুয়ারা নয়াহাট এলাকায় হালদা নদীতে নিষিদ্ধ ইঞ্জিন চালিত নৌকা নদীতে চালানো অপরাধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে চট্টগ্রামের কর্ণফুলি থানাধীন শিকল বাহা এলাকার দানো মেম্বার বাড়ির মো. আদুল আজিজ (৪৫) নামে এক ব্যাক্তিকে ১০ দিনের বিনাশ্রম কারাদ- প্রদান করেছি।

অন্যদিকে হালদা পাড়ের শত শত ডিমসংগ্রহকারী মৎস্যজীবিরা নদীতে কার্পজাতীয় মা-মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করার জন্য এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তৈরি করা হয়েছে মাটির কূয়া। নৌকা, জাল, বড় পাতিলসহ ডিম ধরার বিভিন্ন সরঞ্জামও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে হালদায় ডিম ছাড়তে পারে মা-মাছ।

ডিম সংগ্রহকারীরা জানান, ডিম ধরার উৎসবে মেতে উঠতে নদীর দুই পাড় রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার শত শত ডিম সংগ্রহকারী মাটি ও পাকা কূয়া, নৌকা, ডিম ধরার মশারি জাল, বালতিসহ অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে অপেক্ষা করছেন।

আগামী পূর্ণিমায় মেঘের গর্জন, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢল নামলেই ডিম দিতে পারে মা-মাছ। এ সময় ডিম ধরা উৎসবে মেতে উঠবেন তারা এবং এবার তাদের আশা (ডিম সংগ্রহকারীরা) রেকর্ড পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করবে। তবে হালদার ভাঙন রোধে তীর সংরক্ষণ বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত যান্ত্রিক যানের ডুবন্ত ঘূর্ণয়মান পাখার আঘাতে যেভাবে মাছের মৃত্যু হয়েছে। ফলে কার্পজাতীয় মা-মাছেরা তাদের আবাসস্থল এবং তাদের অবাধ বিচরণ ঠিকভাবে করতে পেরেছে কিনা তা নিয়ে শঙ্কায় ডিম সংগ্রহকারী মৎস্যজীবিরা।

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামের হাটহাজারী-রাউজান-ফটিকছড়ি উপজেলা সীমানা দিয়ে বয়ে যাওয়া হালদা নদীতে স্মরণাতীত কাল থেকে প্রতি বছর বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে হালদা নদীতে মা-মাছ ডিম ছাড়ে। ডিম সংগ্রহকারী মৎস্যজীবিরা সরাসরি নিষিক্ত এসব ডিম নদী থেকে সংগ্রহ করে। নদী থেকে ডিম সংগ্রহ করে তা থেকে সনাতন ও আধুনিক পদ্ধতিতে রেণু ফুটিয়ে বিক্রি করে তারা। রেণুর আয় দিয়ে পুরো বছর জীবিকা নির্বাহ করে ডিম সংগ্রহকারী মৎস্যজীবিরা।