ফেনী সোনাগাজী পৌর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসাটি উপজেলার সবচেয়ে বড় মাদরাসা। এমপিওভুক্ত এ মাদরাসার রয়েছে মার্কেট, পুকুর, জমিসহ কোটি কোটি টাকার সম্পদ। প্রাতিষ্ঠানিক ফি থেকে আয় ছাড়াও মাদরাসার সম্পদ থেকে মাসে আসে লাখ লাখ টাকা। পরিচালনা কমিটির সঙ্গে আঁতাত করে অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ দৌলা এসব সম্পদের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন। মাদরাসার এ আয়ের টাকা লোপাট করে পরিচালনা কমিটির পাশাপাশি বেয়াদব বলে পরিচিত কিছু জ্যেষ্ঠ ছাত্রকে অনুসারী হিসেবে তৈরি করেছেন সিরাজ।

তাদের ছাত্রাবাসে ফ্রি খাওয়ানো, ফরম পূরণ বাণিজ্য, নগদ টাকা দেওয়া, ফ্রি গাইড বইসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিতেন তিনি। অধ্যক্ষ সিরাজ জামায়াতে ইসলামী থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর খোলস পাল্টে হয়েছেন আওয়ামী লীগের সমর্থক। একইভাবে মাদরাসায় করেছেন স্বঘোষিত ছাত্রলীগ কমিটি। সুবিধা পেতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিকে নিয়েছেন পরিচালনা কমিটিতে। অবৈধ সুবিধায় পালন করা অন্তত এক ডজন সহযোগী আছে বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজের। তাদের দিয়েই একের পর এক গুরুতর অভিযোগ ধামাচাপা দেন তিনি। এ ছাড়া পরিচালনা কমিটির দায়িত্ব পাওয়া নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের চাপা দ্বন্ধ দেখা দেয়। এর সুযোগ নিয়ে একক আধিপত্য বিস্তার করেন সিরাজ। সরেজমিন অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এবার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন হয়রানির অভিযোগে ধরা পড়লেও এর আগে এমন অনেক অভিযোগ ধামাচাপা দিয়েছেন তিনি। ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা রাফির পরিবারকে হুমকি দিয়ে সফল না হয়ে তাঁর শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর আগে রাফিকে শ্লীলতাহানির মামলায় সিরাজকে গ্রেপ্তারের পর এসব সহযোগী তাঁর মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন এবং মাদরাসায় দফায় দফায় সভা করে।

সূত্রগুলো জানিয়েছে, হিসাব নিরীক্ষণে মাদরাসার ৩৯ লাখ টাকা লোপাটের অভিযোগ ধরা পড়লেও ধামাচাপা দিতে সক্ষম হন সিরাজ। তাঁর বিরুদ্ধে সনদপত্র জালিয়াতি ও চেক জালিয়াতির মাধ্যমে আরেকটি মাদরাসার টাকা আত্মসাতের অভিযোগও আছে। এর আগে মামলায় জেল খেটেও ধামাচাপা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে স্বপদে বহাল থেকেছেন তিনি। অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও পরিচালনা কমিটির সাবেক সদস্যরা জানান, পরীক্ষার আগে প্রশ্ন দেওয়া এবং গাইড দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ছাত্রীদের যৌন নিপীড়ন করতেন সিরাজ। তাঁর বিরুদ্ধে ভয়ে কেউ মুখ খুলতেই সাহস পেত না। দু-একজন অভিযোগ করলেও সেটি চাপা দিয়ে দেন তিনি। উপজেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন এখন সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি।

স্থানীয় লোকজন বলছে, সিরাজের সঙ্গে রুহুল আমিনের বেশ ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই লোকটা তো জামায়াতের, তার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক থাকতে পারে। তার বিরুদ্ধে আগেও অনেক গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। কয়েক মাস আগে আরেক ছাত্রীর যৌন হয়রানি করেছিল সে।

তথ্য আছে, গত বছরের ৩ অক্টোবর আলিমের ছাত্রীকে (রাফির সহপাঠী) একইভাবে নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে হয়রানির অভিযোগ ওঠে সিরাজের বিরুদ্ধে। তখন রুহুল আমিন কমিটিতে ছিলেন, এমন প্রশ্ন তুললে তিনি বলেন, আমি এই মেয়েটির ঘটনা জানার পরই অ্যাকশন নিয়েছি। ওটা আগের। তবে ওই ঘটনার পর সে কিভাবে পার পেল, জানি না! কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগের কমিটির কয়েকজন এবার আসতে পারেনি। এ নিয়ে হয়তো কিছু থাকতে পারে। সিরাজের আরেক রক্ষাকবচ পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাকসুদ আলম। তাঁকে রাফি হত্যাচেষ্টা মামলায় আসামি করা হয়েছে।

জানা গেছে, রাফিকে শ্লীলতাহানি করার অভিযোগে অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর তাঁর পক্ষ নিয়ে মানববন্ধনের আয়োজন করেন তিনি। সিরাজের মুক্তিরও চেষ্টা করেন এবং মাদরাসা কমিটির সভাপতি জেলার অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট পি কে এম এনামুল করিমের কাছে একাধিকবার তিনি সিরাজের পক্ষে সুপারিশ করেন। রাফিকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার পরের দিনই তাঁকে এলাকায় দেখা যায়। এখন গা ঢাকা দিয়েছেন। গতকাল বুধবার মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও মাকসুদকে পাওয়া যায়নি। উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এবং মাদরাসার কমিটির অভিভাবক সদস্য জামশেদ আলমও ছিলেন সিরাজের ঘনিষ্ঠজন। গতকাল তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনিও ফোন ধরেননি।

স্থানীয় সূত্র ও পুলিশ জানায়, মাদরাসা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম মামলার অন্যতম আসামি, যিনি সিরাজের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। বাড়ি চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ভুঁইয়া বাজারে। তাঁর বাবার নাম আব্দুর রাজ্জাক। বখাটে স্বভাবের শামীম এখন ফেনী কলেজে পড়ছে। আগে সোনাগাজী ফাজিল মাদরাসায় পড়ার সময় সিরাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তখন অধ্যক্ষ সিরাজের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। সম্প্রতি তিনি নিজেকে সভাপতি করে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার ছাত্রলীগ কমিটি ঘোষণা করেন। সিরাজের অনুসারীদের দিয়েই এই কমিটি করা হয়েছে। তবে উপজেলা ও জেলা ছাত্রলীগ ওই মাদরাসায় ছাত্রলীগের কোনো কমিটি করা হয়নি বলে দাবি করেছে।

সোনাগাজী উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুল মোতালেব চৌধুরী রবিন বলেন, এখানে মাদরাসায় কোনো কমিটি দেওয়া হয়নি। সে (শামীম) নিজেই নিজেকে সভাপতি দাবি করে। রাফিকে হত্যাচেষ্টার পর থেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন শামীম।

তবে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, শামীম ফেনীতেই অবস্থান করছেন। জানতে চাইলে তাঁর মামা চর চান্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নেয়ামত উল্যাহ স্বপন বলেন, ঘটনার সময় আমার ভাগ্নে ঢাকায় ছিল। সে এসবের মধ্যে জড়িত, এটা জানি না। সে এখন ঢাকায় আছে।

রাফির কয়েকজন সহপাঠী পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ফাজিলের ছাত্র নূর উদ্দিন সিরাজের শিষ্যদলের অন্যতম সদস্য। বখাটে নূর উদ্দিন দুই বছর আগে দাখিল পরীক্ষার সময় রাফিকে উত্ত্যক্ত করেছিলেন। রাফি তার প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার তার গায়ে চুন ছুড়ে মারেন নূর উদ্দিন। মাদরাসার ছাত্রাবাসে আড্ডা এবং ছাত্রাবাসে ফাও খাওয়া ছিল তাঁর প্রতিদিনের রুটিন।

বুধবার বিকেলে উত্তর চর চান্দিয়ায় নূর উদ্দিনের বাড়ি গেলে তাঁর বাবা আহসানউল্যাহ ও মা রাহেলা বেগম বলেন, অধ্যক্ষ সিরাজ তাঁদের চার ছেলের লেখাপড়ার ফি কম নেন। এই কারণে তাঁর সঙ্গে তাঁদের ভালো সম্পর্ক। তাঁরা দাবি করেন, গত শনিবার সকালে নূর উদ্দিন বাড়ি থেকে বের হন। এরপর আর তাঁর খোঁজ নেই।

সোনাগাজী পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ আব্দুল হালিম মামুন আগের পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি বলেন, ১২৫ শতক জমির ওপর মাদরাসার তিনতলা ভবনে মার্কেট, ব্যাংকসহ অনেক কিছু আছে। ভাড়া আসে লাখ টাকার মতো। পুকুর, কাশ্মীরবাজার এলাকার ২০ শতক জমিসহ বিভিন্ন স্থানে প্রায় পাঁচ একর জমিও আছে মাদরাসার। বিভিন্ন ধরনের দানের টাকাও আসে। সব সম্পদের আয় তছরুপ করেন অধ্যক্ষ সিরাজ। গত বছর নিরীক্ষার সময় ৩৯ লাখ টাকার হিসাব দিতে পারেননি তিনি। ২৮ হাজার টাকা ইসলামী ব্যাংকের ভাউচারে জালিয়াতি ধরা পড়ে। এসব কারণে রেজুলেশন করে দুই হাজার টাকার বেশি খরচ করার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয় সিরাজের। কমিটি বদল হলে তিনি সেই রেজুলেশনই বাদ দিয়ে দেন।

আব্দুল হালিম মামুন আরো বলেন, কেউ মুখ খুলতে না চাইলেও গত বছরই আমরা চার-পাঁচটি মেয়ের কথা জেনেছি। যাদের বই দেবে, প্রশ্ন দেবে বা অন্য সুবিধা দেবে বলে রুমে ডেকে হয়রানি করেন সিরাজ। অভিযোগ উঠলেও তদন্ত হয়নি। আগের কমিটি মাদরাসায় সিসি ক্যামেরা স্থাপনের সিদ্ধান্ত দিলেও নিজের অপকর্ম ধরা পড়বে বলে সিরাজ তা বসায়নি। তিনি আরও বলেন, সিনিয়র কিছু বেয়াদব টাইপের ছেলেকে সুবিধা দিয়ে পোষেণ সিরাজ। এরা ফরম ফিলাপ করায়। ফ্রি ছাত্রাবাসে খায়। টাকাও পায়। এরাই তাঁর পক্ষে মাঠে নেমেছে বলে শুনেছি।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, অভিযুক্তদের মধ্যে মামলায় আসামি করা হয়েছে সিরাজের ঘনিষ্ঠ সাবেক ছাত্র জোবায়ের আহমেদ, সাবেক ছাত্র এবং চিহ্নিত মাদক কারবারি রহমত উল্যাহর ছেলে জাবেদ হোসেন, আলিম পরীক্ষার্থী হাফেজ আরিফুর রহমান, হাফেজ আব্দুল কাদির, ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক আফছার উদ্দিন, সাউথইস্ট ব্যাংকের গুণবতী শাখার কর্মকর্তা ও সাবেক ছাত্র কেফায়েত উল্যাহ জনি, ছাত্র আলাউদ্দিন, নূর হোসেন ও শহিদুল ইসলামকে। ফেনী কলেজের ছাত্র (মাদরাসার সাবেক ছাত্র) মহিউদ্দিন শাকিল ঘটনার পর রাফির স্বজনদের হুমকি দিচ্ছেন বলে জানা যায়। গত সোমবার রাফির ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে প্রথমে যে মামলা করেন সেখানে চারজনকে সন্দেহভাজন বলা হলেও আসামি ছিল অজ্ঞাত। গত মঙ্গলবার এ মামলায় সম্পূরক এজাহারে সিরাজ উদ দৌলাসহ আটজনের নাম দেওয়া হয়।

যৌন হয়রানির অভিযোগ ধামাচাপা : রাফির শ্লীলতাহানির মামলায় সাক্ষী করা হয় তাঁর চার সহপাঠী ও মাদরাসার দপ্তরি নূরুল আমিনকে। এসব সাক্ষী ও অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধ্যক্ষ সিরাজ এর আগেও যৌন হয়রানি করে পার পেয়ে যান। গত বছরের ৩ অক্টোবর উপবৃত্তির তালিকায় নাম দেওয়ার কথা বলে রাফির এক সহপাঠীকে কক্ষে ডেকে নেন সিরাজ। এরপর শ্লীলতাহানি করেন। এ ঘটনায় ওই ছাত্রীর বাবা মাদরাসা কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন। কিন্তু ঘটনার কোনো তদন্ত হয়নি।

উল্লেখ্য, গত ২৭ মার্চ আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে কক্ষে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানির অভিযোগে অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে মামলা করেন তাঁর মা। ওই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে আছেন অধ্যক্ষ। এর মধ্যে গত শনিবার পরীক্ষা হল থেকে ডেকে নিয়ে রাফির গায়ে আগুন দিয়ে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। বুধবার রাতে সবার প্রার্থনা- চেষ্টাকে বিফল করে চলেই গেলো প্রতিবাদী নুসরাত।