উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে সারাদেশে পালিত হচ্ছে পহেলা বৈশাখ। বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বলা হয়েছে, দেশজুড়ে নানান আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে সর্বজনীন এ উৎসব। কোনও ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা প্রতিরোধে বিভিন্ন জায়গায় নেওয়া হয় ব্যাপক প্রস্তুতি।

চট্টগ্রাম ব্যুরো: নতুন বছর, নতুন প্রাণে জেগে ওঠা। বাঙালি জাতির আপন অস্তিত্বের শেকড় আরেকবার পরখ করে দেখার দিন।সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মেতে ওঠার দিন পহেলা বৈশাখ। রক্ষণশীলদের বিধিনিষেধের বেড়াজাল ভেঙ্গে বাঙালি মেতে ওঠেছে নতুনের উল্লাসে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের দিকে দিকে বৈশাখের জয়গান। উৎসবে মাতোয়ারা চট্টগ্রামবাসী।

রোববার (১৪ এপ্রিল) সকালের নতুন সূর্যোদয়ের পরই চট্টগ্রাম নগরীতে শুরু হয়েছে বৈশাখের আবাহন। নগরীর ডিসি হিল, সিআরবির শিরীষতলা- এই দু’টি মূল ভেন্যু তো আছেই, নগরজুড়ে এমন কোনো সড়ক, জনপদ, অলিগলি নেই যেখানে বর্ষবরণের উন্মাদনার ছোঁয়া লাগেনি। বাজছে বৈশাখের গান, নতুন শাড়ি, নতুন পাঞ্জাবি জড়িয়ে অলি-গলিতে সরব পদচারণা উৎবসপ্রিয় বাঙালির।

সকালের দিকে ডিসি হিল-সিআরবিতে মানুষের আনাগোনা কিছুটা কম থাকলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে রীতিমতো মানুষের ঢল নেমেছে। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ডিসি হিলের প্রবেশপথে দর্শনার্থীদের সারি চেরাগি পাহাড়ের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শিরীষতলায় প্রবেশে ইচ্ছুক দর্শনার্থীর সারিও ছিল মূল মঞ্চ থেকে অন্তত এক কিলোমিটার দূরে।

নানান বয়সী শিশু কিশোর, তরুণ তরুণী বৃদ্ধরাও নববর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। পরস্পরের সঙ্গে নববর্ষেও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন তারা। সবার পরনে ছিল নতুন বছরের নতুন পোশাক।নগরীর ডিসি হিলে এবার ৪১তম বর্ষবরণের আয়োজন করেছে সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদ। প্রতিবারের মতো এবারও তাদের স্লোগান ‘পহেলা বৈশাখ বাঙালির উৎসব, সবার যোগে জয়যুক্ত হোক’।

সকালে শ্রুতি-অঙ্গনের ভৈরবী রাগে ধ্রুপদ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে ডিসি হিলে শুরু হয় বর্ষবরণের আয়োজন। এরপর থেকে চলছে বিভিন্ন সংগঠনের নাচ-গান ও আবৃত্তি পরিবেশনা। একক পরিবেশনাও চলছে মাঝে মাছে।সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক আহমেদ ইকবাল হায়দার বলেন, পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। আমাদের বড় পরিচয় আমরা বাঙালি। এই একটি উৎসবে আমরা ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষ একত্রিত হয়। কোনো বিধিনিষেধ দিয়ে বাঙালিকে তার এই প্রাণের আয়োজন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যাবে না।

নগরীর সিআরবির শিরীষতলায় ভায়োলিনিস্ট চিটাগং নামের একটি সংগঠনের বেহালা বাদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বৈশাখ বরণের মূল আয়োজন। গানে-নাচে উৎসবমুখর পাহাড়ঘেরা নৈসর্গিক সিআরবি এলাকায় যেন মানুষের জোয়ার নেমেছে। রোদ্রের তীব্রতা ও গরম উপেক্ষা করে মানুষ ছুটছে প্রাণের উৎসবে।

সিআরবি’র আয়োজক সংগঠন নববর্ষ উদযাপন পরিষদের সংগঠক ডা.চন্দন দাশ বলেন, যুগে যুগে বাঙালি জাতির আবহমান উৎসবকে ধর্মের বিধিনিষেধ দিয়ে আটকানোর চেষ্টা হয়েছে। বাঙালি কখনোই রক্ষণশীলতা-পশ্চাৎপদতার কাছে পরাভব মানেনি। এবারও বর্ষবরণের আয়োজনে চট্টগ্রামে যে মানুষের ঢল নেমেছে, সেটা প্রমাণ করে যে বাঙালি তার জাতিসত্তার আবহমান ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

সিআরবিতে বিকেলে অনুষ্ঠিত হবে ঐতিহ্যবাহী সাহাবুদ্দিনের বলীখেলা। সেই বলীখেলা দেখতে প্রতিবছর শত শত মানুষ ভিড় জমায়এদিকে রোববার সকাল ১০টায় নগরীর সার্সন রোডে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয়ে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা।নগরীর ডিসি হিলে পহেলা বৈশাখের উৎসবে আসা একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হুমায়রা নওরীন বলেন, ‘পহেলা বৈশাখ তো শুধু একটি উৎসব নয়। এটি বাঙালির একটি সম্মিলনের আয়োজন। এই উৎসব মানবিকতার কথা বলে। আজ সমাজে মানবিকতার খুবই অভাব। আমরা আজ দেখছি- মাদ্রাসার ভেতরে ছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিদিন খুন, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে চলেছে। বাঙালির এই সম্মিলিত উৎসব থেকে আমরা এসব অনাচারের প্রতিবাদ এবং মানবিক সমাজ নির্মাণের কথা বলতে চাই।

যশোর: নুসরাত হত্যার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে যশোরে বর্ষবরণ করে নেওয়া হলো। ১৪২৬ বঙ্গাব্দ বরণ উপলক্ষে শহরজুড়ে আয়োজন করা হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলার।মঙ্গল শোভাযাত্রা ও সুরের মূর্চ্ছনায় নতুন বছরের প্রথম সকালে উৎসব সাজে সজ্জিত নারী, শিশুসহ নানা বয়সের মানুষের পদভারে মুখর হয়ে ওঠে যশোর শহর। রবিবার (১৪ এপ্রিল) সকাল ৬টা ৩১ মিনিটে পৌর উদ্যানে উদীচী যশোরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়। ভৈরবী সুরে সেই চিরায়ত, এসো হে বৈশাখ সংগীতে স্বাগত জানানো হয় নববর্ষের প্রথম সকালকে। একইসঙ্গে আশা করা হচ্ছে, নতুন বছরে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে। উদীচীর অনুষ্ঠানের প্রতিপাদ্য ছিল, নুসরাত হত্যার প্রতিবাদ।

হবিগঞ্জ: হবিগঞ্জে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বর্ষবরণ চলছে। রবিবার ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে খেলাঘর আসরের আয়োজনে শিরিষ তলায় নববর্ষের সূর্যকে বরণ করা হয়। এরপর মুড়ির মোয়া, খই, নাড়ু বিতরণ করা হয়। পরিবেশন করা হয় নৃত্য ও বাঙালির ঐতিহ্যবাহী গান।

এরপর সকাল সাড়ে ৯টায় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শহরে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রায় হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি আবু জাহির, জেলা প্রশাসক মাহমুদল কবির মুরাদ, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যাসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে।

লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুরে উৎসবমুখর পরিবেশে বাংলা নববর্ষ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ বরণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে রবিবার (১৪ এপ্রিল) সকালে কালেক্টরেট ভবন প্রাঙ্গণ থেকে একটি বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এসময় লাঠি খেলা ও পালকি প্রদর্শনের মতো বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। এতে জেলার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ দলমত নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করেন।

শোভাযাত্রা শেষে কালেক্টরেট প্রাঙ্গণে বেলুন উড়িয়ে পাঁচ দিনব্যাপী লোকজ মেলা ও মনোজ্ঞ সংগীতানুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক অঞ্জন পাল। এসময় উপস্থিত ছিলেন, পুলিশ সুপার আ স ম মাহাতাব উদ্দিন, সিভিল সার্জন ডা. মোস্তফা খালেদ, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু, সাধারণ সম্পাদক নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন প্রমুখ।

মেহেরপুর: পহেলা বৈশাখে শহীদ সামসুজ্জোহা পার্কে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও মেহেরপুর জেলা প্রশাসনের আয়োজনে চলছে বৈশাখ বরণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, মেহেরপুর জেলা প্রশাসক আতাউল গনি, পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমানম, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম রসুল, পৌর মেয়র মাহফুজুর রহমান রিটন, উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাড. ইয়ারুল ইসলামসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয়। জেলা প্রশাসন চত্বর থেকে শুরু হয়ে শোভাযাত্রাটি শহীদ সামসুজ্জোহা পার্কে গিয়ে শেষ হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন।

পঞ্চগড়: পঞ্চগড়ে বর্ণাঢ্য আয়োজনে বাংলা নববর্ষ ১৪২৬ বরণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে সকালে জেলা প্রশাসন কালেক্টরেট আদর্শ শিক্ষা নিকেতন থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে। জেলা শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে আবার সেখানে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে অনুষ্ঠিত হয় পান্তা উৎসব। এছাড়া, বাঙালির চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি উৎসব, লাঠি খেলা,হাডুডু,সাপ খেলা, বানর নাচসহ নানা আয়োজন করা হয়।

মঙ্গল শোভাযাত্রায় পঞ্চগড়-১ আসনের সংসদ সদস্য মজাহারুল হক প্রধান, জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন, পুলিশ সুপার গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদাত সম্রাট, সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন, স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষ নানান সাজে অংশ নেন।

এছাড়া, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে জেলা উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, নাট্য সংগঠন ভূমিজ, দিশারী নাট্যগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সংগঠনের আয়োজনে পৃথকভাবে আনন্দ শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, যাত্রাপালাসহ দিনভর রয়েছে নানান পরিবেশনা।

জয়পুরহাট : নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে জয়পুরহাটে পালিত হচ্ছে বাংলা নববর্ষ। বাংলা নববর্ষকে বরণ করতে জেলা প্রশসনের পক্ষ থেকে সূচনা সংগীত পরিবেশন, আনন্দ শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গ্রামীণ খেলাধূলা ও পান্তাভাত খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে।

দিবসটির শুরুতেই শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দানে সূচনা সংগীত পরিবেশন করেন জয়পুরহাট রবীন্দ্র সম্মিলন পরিষদের শিল্পীরা। জেলা প্রশাসনের আয়োজনে সকাল আটটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বের করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণের পর কালেক্টরেট চত্বরে গিয়ে শেষ হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। পরে সেখানে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন জেলা প্রশাসক জাকির হোসেন, জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল বারিক, পুলিশ সুপার রশীদুল হাসান, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান রকেট, জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জয়পুরহাট সদর উপজেলার নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান এস এম সোলায়মান আলী প্রমুখ। অনুষ্ঠানে সমবেত কণ্ঠে বর্ষবরণ সংগীত পরিবেশন করেন স্থানীয় শিল্পীরা।