দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদায় একের পর এক বেড়ে চলেছে মৃত ডলফিনের (শুশুক) সংখ্যা। এতে বেড়ে চলেছে মৃত শুশুকের সংখ্যা। গত মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) সন্ধ্যায় মদুনাঘাট সেতু সংলগ্ন এলাকায় হালদা নদীতে ফের মিলল বিশ্বের অতি বিপন্ন শুশুকের দ্বিখন্ডিত একটি মৃত বাচ্চা। কার্প জাতীয় (রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাইশ) মা-মাছ ডিম ছাড়ার মৌসুমে শুশুক ও মা-মাছসহ বিভিন্ন জীববৈচিত্র্যের মারা যাওয়া তথা হালদা নদীর মা-মাছ ও জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পতিত হওয়া নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে হালদা নদীর সাথে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞমহল।

তারা বলছেন, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নিষিদ্ধ নদীতে যান্ত্রিক যান (ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও ড্রেজার) এর ডুবন্ত ঘূর্ণয়মান পাখার আঘাতে মিঠা পানির বিশ্বের অতি বিপন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণী শুশুক ও নদীতে থাকা নানা প্রকার জীববৈচিত্রেরও অকাল মৃত্যু হচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিগত ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় বছরে হালদা নদীতে অতি বিপন্ন স্তন্যপায়ী স্বাদু পানির পরিবেশ নিদের্শক ২০টি শুশুকের মৃত্যু হয়েছে।

সূত্র জানায়, বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার এ নদীতে ভাটায় যখন নদীর পানির স্তর কমে তখন নদীতে চলাচল করা যান্ত্রিক যানের ডুবন্ত ঘূর্ণয়মান পাখার আঘাতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন প্রজাতির জীববৈচিত্রের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। তারমধ্যে বিশ্বে¦ অতি বিপন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী স্বাদু পানির পরিবেশ নিদের্শক স্তন্যপায়ী শুশুক অন্যতম। কারণ শুশুকরা যান্ত্রিক যানের ডুবন্ত ঘূর্ণয়মান পাখার আঘাত মোটেও সহ্য করতে পারেনা। এভাবে যদি নদীর জীববৈচিত্র গুলো মারা যায় তাহলে হালদা নদীতে এক সময় মাছের অভয়ারণ্য থাকবে কিনা এতে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করছে হালদা নদীর সাথে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞমহল।

এদিকে মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) সন্ধ্যায় হালদা নদীর মদুনাঘাট এলাকায় একটি মৃত শুশুকের বাচ্চা মরে ভেসে উঠে। ওই মৃত শুশুকের বাচ্চাটি নদীতে ভাসতে দেখে স্থানীয় জনতা হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়াকে অবহিত করে বলে জানান। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে ওই হালদা গবেষক মুঠোফোনে এ প্রতিবেদককে জানান, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) লাল তালিকাভুক্ত বিশ্বে¦ অতি বিপন্ন প্রজাতির স্বাদু পানির পরিবেশ নিদের্শক এ জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো এভাবে মারা যাচ্ছে। এছাড়া গত ৯ এপ্রিল সকালে হালদা নদীর খলিপার ঘোনা এলাকায় ৮ কেজি ওজনের প্রায় ৩ ফুট (৩৩ ইঞ্চি) দৈর্ঘ্য একটি মৃগেল (মা মাছ) মাছ মরে পচে ভেসে ওঠে। মাছটির শরীরে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন ছিল। তাছাড়া ৫ মার্চ অংকুরী ঘোনা এলাকায় ১৫ কেজি ওজনের প্রায় ৩ ফুট দৈর্ঘ্য একটি কাতলা (মা-মাছ) মরে পচে ভেসে ওঠে। মাছটির মাথায় ও লেজে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। একই দিনে ৩-৪ কেজি ওজনের আরও একটি আইড় মাছ মরে ভেসে ওঠে। প্রায় আড়াই ফুট দৈর্ঘ্য ওই মাছটিরও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন দৃশ্যমান ছিল।

তিনি আরও জানান, নদীতে মা-মাছ ডিম ছাড়ার আগাম সময়ে এভাবে মা-মাছ ও বিভিন্ন জীববৈচিত্র্যের মারা যাওয়া নিয়ে বেশ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছে হালদার সাথে সংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে হালদা নদীর মা-মাছ ও জীববৈচিত্র হুমকি পতিত হবে। যা আমাদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। মঙ্গলবার মদুনাঘাট সেতু সংলগ্ন এলাকায় মরে ভেসে ওঠা প্রায় দেড় ফুট দৈর্ঘ্য ওই শুশুকটি ছিল অপ্রাপ্ত বয়স্ক। বয়স ছয় থেকে সাত মাস। শুশুকটির শরীরের মাঝ বরাবর প্রায় দ্বিখ-ত হয়ে গেছে, গায়ে পচন ধরেছে। আঘাতের ধরন দেখে মনে হয়েছে, যে মৃত শুশুকের বাচ্চাটি মরে ভেসে উঠেছে তা ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও ড্রেজার এর ডুবন্ত ঘূর্ণয়মান পাখার আঘাতে মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্বে থাকা ওই শিক্ষক অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়ার সাথে আলাপকালে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, বিশ্বে অতি বিপন্ন স্তন্যপায়ী স্বাদু পানির একটি প্রাণী শুশুক। এ প্রাণিকে ২৫-৩০ বছর আগেও বাংলাদেশের নদীগুলোতে অনেক দেখা যেত। কিন্তু এখন আর ওই প্রাণীটাকে তেমন দেখা যায় না। দিন দিন এদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। তাই ১৯৯৬ সাল থেকে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় নাম উঠে গেছে শুশুকের। এটি নদীর পরিবেশ নিদের্শক প্রজাতি।

তিনি আরও জানান, বিশ্বের উন্নত দেশে এ জাতীয় শুশুক সংরক্ষণের জন্য সরকারি ভাবে নানা উদ্যেগ গ্রহন করা হয়ে থাকে। এ জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী অন্যান্য মাছের মত ডিম ছাড়ে না। এ গুলো বাচ্চা প্রসব করে। বাচ্চা গুলো মার দুধ পান করে বেঁচে থাকে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রায় ১২শ’টি শুশুক আছে। যার মধ্যে হালদায় আছে মাত্র ২০০-২৫০টি। তবে বিগত ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় বছরে হালদা নদীর প্রায় ২০টি শুশুক মারা গেছে। পরিবেশ উপযোগী হলে এসব শুশুক হালদা নদীতে থাকবে। অন্যথায় পরিবেশ যখন প্রতিকুল হবে শুশুক এ নদীতে থাকবে না।
খবর নিয়ে জানা যায়, হালদা ও কর্ণফুলীর সংযোগে থাকা বন্দর কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন চর থেকে এখনো ড্রেজার বসিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। এসব বালু পরিবহন করা হচ্ছে হালদার নদীর মুখ হয়ে কালুরঘাটের দিকে। বিক্ষিপ্তভাবে হালদার বিভিন্ন পয়ন্টে বালু নিয়ে যাচ্ছে নৌযানে করে। মোহরা এলাকার জনসাধারণ সূত্রে জানা যায়, হালদায় বালুবাহী নৌযানের উৎপাত বন্ধে এলাকার মানুষ সোচ্ছার হচ্ছে। গত মঙ্গলবার কয়েকটি নৌযান তারা নদীর কিনারায় বালু নিয়ে ভিড়তে দেয়নি।

প্রসঙ্গত, সরকার ২০১০ সালে চট্টগ্রামের নাজিরহাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত হালদা নদীর প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকাকে জলজ প্রাণীর অভয়ারণ্য ঘোষণা করে। তবে বর্তমানে তা প্রায় অকার্যকর হতে চলেছে।