ছিলনা অমাবস্যা বা পূর্ণিমার তিথি। তবে গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে আকাশে শুরু হয় মেঘের গর্জন। রাত থেকে থেমে থেমে চলছে ভারী বৃষ্টি। প্রচুর পরিমাণে পাহাড়ি ঢলও নামে। শনিবার সকালে মেঘের গর্জন, ভারী বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল, ঘোলা পানি সব কিছু মিলিয়ে ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলে বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র চট্টগ্রামের হালদা নদীর হালদা নদীর বিস্তীর্ণ এলাকায় রুই জাতীয় (রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাইশ) দ্বিতীয় দফায় নমুনা মা-মাছ ডিম ছাড়ে। ওই দিন রাতে পূর্ণমাত্রার ডিম সংগ্রহ তথা সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় নৌকা, জাল ও বালতিসহ নানা সরঞ্জাম নিয়ে অপেক্ষা করেছে ডিম আহরণকারীরা। রুই জাতীয় মাছের ডিম আহরণের অপেক্ষায় তখন হালদা নদীর পাড়ে চলেছিল উৎসবের আমেজ।

রাত যত বাড়ে, তত মানুষের হাঁকডাক বাড়তে থাকে নদীতে। শনিবার (১৫) রাত পৌনে ৯টা থেকে নদীতে জেলেদের জালে বাড়তে থাকে ডিম পাওয়ার পরিমাণ। হালদা নদীর চারটি পয়েন্টে মা-মাছ ধীরে ধীরে ডিম ছাড়তে শুরু করে। তবে রাত ১২টার দিকে পূর্ণমাত্রায় ছাড়ার পর শত শত ডিম আহরণকারী জাল ফেলে ডিম সংগ্রহে নেমে পড়েন। না ঘুমিয়ে সারারাত অবধি ভোর রাত পর্যন্ত শত শত মৎস্যজীবি ২ শতাধিক নৌকায় নিয়ে ডিম আহরণকারী করে। তবে মা-মাছের দেওয়া সংগৃহীত নিষিক্ত ডিমের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ। শুধুমাত্র ৭ হাজার কেজি হবে বলে জানিয়েছেন হালদা গবেষকরা। ফলে এ বছর আশানুরুপ ডিম আহরণ করতে না পারায় ডিম সংগ্রহকারীদের মাঝে হতাশার ছাপ পরিলক্ষিত হয়।

সরেজমিনে ডিম ছাড়ার স্থানসমূহ ঘুরে দেখা গেছে, শনিবার বিশেষ করে মধ্যরাত থেকে রবিবার ভোর রাত পর্যন্ত ৫ শাতাধিক ডিম সংগ্রহকারীরা ২৩০টি নৌকা, জাল ও বালতিসহ ডিম আহরণের নানা সরঞ্জাম নিয়ে হালদার হাটহাজারী ও রাউজান অংশের খলিফার ঘোনা, পোড়াকপালি, আজিমের ঘাট, নাপিতের ঘাট ও রামদাস মুন্সীর হাট প্রায় ৬ কিলোমিটার এলাকায় নৌকা নিয়ে আহরণকারীরা নদীতে অবস্থান নিয়ে ডিম সংগ্রহ করেছে।

হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা নয়াহাট এলাকার স্থানীয় ডিমসংগ্রহকারী কামাল সওদাগর ও রাউজানের অংকুরী ঘোনা এলাকার উদয়ন বড়ুয়া এ প্রতিবেদককে জানান, শনিবার সন্ধ্যার পর থেকে নদীতে ডিমের পরিমাণ বাড়তে থাকে। ডিম ছাড়ার অপেক্ষায় নদীতে আছেন রাত যত বেড়েছে ডিমের আহরণের পরিমাণ তত বেড়ছে। নদীতে ওই মুহুর্তে প্রায় ২৩০টি নৌকা ছিল। এসব নৌকায় করে জেলেরা মা-মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করছে। কেউ এক বালতি, কেউ ২-৩ বালতি পর্যন্ত ডিমসংগ্রহ করেছেন। এতে কোনো কোনো নৌকায় সর্বনিম্ন এক কেজি থেকে সর্বোচ্চ ৪ কেজি করে ডিম সংগ্রহ করেছে বলে তারা জানান ।

এদিকে, হাটহাজারী উপজেলার মদুনাঘাট হ্যাচারিতে ৬০টি নৌকায় ১০০ বালতি ডিম ও শাহামাদারী হ্যাচারিতে ৩০টি নৌকায় ৬০ বালতি ডিম সংগ্রহ করেছেন। প্রতি বালতির ওজন ১৫ কেজি। এ পর্যন্ত ২ হাজার ৪০০ কেজি ডিম দুটি হ্যাচারিতে এসেছে। সময় যত বাড়বে, ডিমের পরিমাণ তত বাড়বে বলে জানান হাটহাজারী উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আজহারুল আলম।

নদী থেকে আশানুরুপ ডিম আহোরণ করতে না পারায় ডিম সংগ্রহকারীদের চোখে-মুখে হতাশার ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছিল। নদী অবস্থানরত নাম প্রকাশ না করা শর্তে হালদা পাড়ের এক ডিম সংগ্রহকারী এ প্রতিবেদককে জানান, এ বছর মা-মাছের দেওয়া সংগৃহীত নিষিক্ত ডিমের পরিমাণ অনেক কম। আগের বছর (২০১৮) এর তুলনায় এক তৃতীয়াংশ। মাত্র ৭ হাজার কেজির মত হবে। অথচ বিগত ১০ বছরের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গত বছর হালদায় থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল ২২ হাজার ৬৮০ কেজি। ওই বছর আমরা প্রতি নৌকায় সর্বনিম্ন ৩ কেজি থেকে সর্বোচ্চ ৮ কেজি করে মা-মাছেরে নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করেছিলাম। সে তুলনায় আমরা এ বছর একেবারে শেষ হয়ে গেছি।

এ বছর রুই জাতীয় মা-মাছ কম পরিমাণে ডিম ছাড়ার কারণ জানতে চাইলে হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, শনিবার রাতে জোয়ার আসার পর মা-মাছ ডিম ছেড়ে দিয়েছে। তবে পরিমাণে একেবারেই কম। করণ অবৈধভাবে ড্রেজার দিয়ে হালদা নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ, ঘেরা-ভাসা জাল দিয়ে মা-মাছ নিধন, ইঞ্জিন চালিত নৌযান ও ড্রেজারের ঘুণায়মান ডুবন্ত পাখার আঘোতে মা-মাছের মৃত্যু এবং রুই জাতীয় মা-মাছের অবাধ বিচরণে বাধাঁ সৃষ্টি করেছে। এছাড়া অপরিকল্পিত রাবার ড্যাম, পাহাড়ে তামাক চাষ ও এপ্রিল মাসের দিকে পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টি না হওয়ায় এমনটা হয়েছে। তবে দ্বিতীয় দফায় মা-মাছ ডিম ছাড়বে কিনা এমন প্রশ্নের জবারে তিনি বলেন, আশা করা যেতে পারে। তবে দ্বিতীয় দফা ডিম ছাড়ার সম্ভবনা খুবই কম।

এ ব্যাপারে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমীন বলেন, হালদা নদীতে মা মাছের ডিম দেওয়ার খবর পান শনিবার রাত পৌনে নয়টার সময়। ঘোনা এলাকায় রোসাংগির নামের এক ডিম সংগ্রহকারী তাঁকে মুঠোফোনে ডিম পাওয়ার সংবাদটি প্রথম জানিয়েছেন। তিনি বলেন, নদীতে প্রতিটি নৌকায় এক থেকে দুই বালতি করে ডিম পেয়েছেন সংগ্রহকারীরা। যদিও তা বিগত সময়ের তুলনায় অনেকাংশ কম।

তিনি আরও জানান, হালদা নদীতে নির্বিঘœভাবে মা-মাছ যাতে চলাচল করতে প্রতিদিন ড্রেজার দিয়ে হালদা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ, অবৈধ জাল ও ইঞ্জিন চালিত নৌকা ধ্বংস এবং মাছ শিকারীদের বিরুদ্ধে রাতদিন ভ্রাম্যমাণ অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে যুদ্ধ করেছি। গত সাত মাসে প্রায় ১ লক্ষ ঘনফুট বালু, ১ লক্ষ ৩০ হাজার মিটার কারেন্ট জাল জব্দ করেছেন। ধ্বংস করেছেন ৫টি ড্রেজার, ৮টি বালু উত্তোলনকারী ইঞ্জিন চালিত নৌকা। জরিমানা করে আদায় করেছেন নগদ ৫০ হাজার টাকা। দুই জনকে একমাস করে কারা- এবং জব্দকৃত বালু নিলামে বিক্রয় করে ২ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছি।

এদিকে, সংগৃহীত মা-মাছের নিষিক্ত ডিমের পরিমাণ কম হওয়ায় হালদা পাড়ে কৃত্রিম রেনু পোনা উৎপাদনকারী ও বিক্রেতারা বেশ তৎপরতা চালাচ্ছে। এতে করে প্রকৃত ডিম সংগ্রহকারীদের মধ্যে আতংকে ভুগছে। কৃত্রিম রেনু পোনা উৎপাদন কারী ও বিক্রেতারা তৎপরতা সর্ম্পকে জেলা মৎস্য কর্মকর্তামোমিনুল হক এর কাছে জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, এই রকমের কোন কিছু আমি দেখিনি। আমার সার্বক্ষনিকভাবে হালদা পাড়ে আছি। যদি এরকমের কোন কিছু দেখা যায় তা হলে তারা তাৎক্ষনিকভাবে এই ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
প্রসঙ্গত, প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। এটি বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটা নদী যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে পূর্ণিমায় প্রবল বর্ষণ আর মেঘের গর্জনের পর পাহাড়ি ঢল নামলে হালদা নদীতে রুই জাতীয় মাছ স্মরণাতীত কাল থেকে ডিম ছেড়ে আসছে।