ছয় খুনসহ ১৭ মামলার আসামি অমিত মুহুরী (৩২) গত বুধবার গভীর রাতে চট্টগ্রাম কারাগারে খুন হয়েছেন। কারাগারের ৩২ নম্বর সেলে রিপন নাথ নামে অপর কয়েদির ইটের আঘাতে মাথার পেছনে গুরুতর আঘাত পান অমিত। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাত সোয়া ১টায় তিনি মারা যান। অমিত মুহুরী যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এবং যুবলীগের কেন্দ্রীয় উপঅর্থসম্পাদক হেলাল আকবর বাবরের অনুসারী ছিলেন। তার বাবার নাম অরুণ মুহুরী, বাড়ি নগরীর নন্দনকানন গোলাপ সিং লেনে। অমিত মুহুরীর মৃত্যুর খবর শুনে নগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের শতাধিক নেতাকর্মী রাত ২টার দিকে চমেক হাসপাতালে এসে ভাঙচুর চালান। তারা ২৮ নম্বর নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডের কলাপসিবল গেট ও ওয়ার্ডের বিভিন্ন কক্ষের কাচ ভেঙে ফেলেন। চমেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক জহিরুল হক ভূঁইয়া জানান, তাদের এমন আচরণের পর পুলিশ এসে ধাওয়া দেয়। তখন হামলাকারীরা হাসপাতাল ত্যাগ করেন। চমেক হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার খুরশিদ আনোয়ার চৌধুরী জানান, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রোগীর মৃত্যু হয়েছে। তার মাথার পেছনের দিকের আঘাত ছিল গুরুতর। হাসপাতালে আনার পর থেকেই তাকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছিল। জেল পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, সম্ভবত জেলখানা থেকে বের করার আগেই অমিত মুহুরী মারা যান। ইটের আঘাতে তার মাথার পেছনটা থেঁতলে ফেলা হয়েছিল।

মামলার সুরতহাল প্রতিবেদনেও ‘মাথার পেছনে আঘাতজনিত কারণে’ মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অমিত খুনের ঘটনায় রিপন নাথ নামে অপর কয়েদিকে আসামি করে বুধবার গভীর রাতেই চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার নাসির আহমেদ বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। রিপন নাথের বাবার নাম নারায়ণ নাথ। বাড়ি সীতাকু- উপজেলার ফেদানগর গ্রামে। মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, চট্টগ্রাম কারাগারের ৩২ নম্বর সেলের ৬ নম্বর কক্ষে থাকতেন অমিত মুহুরীসহ তিনজন। এর মধ্যে একজনের সঙ্গে অমিতের বনিবনা না হওয়ায় তাকে অন্যকক্ষে সরিয়ে বুধবার বিকালে রিপন নাথ নামে অন্য এক হাজতিকে ওই কক্ষে আনা হয়। কিন্তু রিপনের সঙ্গেও অমিতের ঝগড়া হয়। বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে শাহ আলম নামে এক কারারক্ষী অমিতদের কক্ষে চিৎকারের শব্দ শুনে সেখানে আসেন। তখন তিনি দেখেন রিপন নাথ একটি ভাঙা ইটের একপাশের সুচালো অংশ দিয়ে অমিতের মাথার পেছনে আঘাত করে চলেছেন। তখন আরও কয়েকজন কারারক্ষী মিলে অমিতকে উদ্ধার করে কারা হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। অমিত মুহুরীর বিরুদ্ধে ১৭ মামলার পরোয়ানা রয়েছে উল্লেখ করে মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০১৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তাকে চট্টগ্রাম কারাগারে আনা হয়।

অমিত মুহুরীর বিরুদ্ধে যে ১৭ মামলা আছে, তার মধ্যে ছয়টি হত্যার অভিযোগের। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট নগরীর নন্দনকানন হরিশদত্ত লেনের ছয়তলায় নিজ বাসায় যুবলীগ নেতা ও বন্ধু ইমরানুল করিম ইমনকে খুন করেন। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে অমিত মুহুরী বলেছিলেন ইমনকে টানা দুদিনে খুন করা হয়। প্রথম দিন তার হাতের আঙুল কাটা হয়। পর দিন কুপিয়ে ও গলায় ছুরি চালিয়ে জবাই করা হয়। মৃত্যু নিশ্চিত করার পর লাশটি প্রথমে পোড়ানো হয়। এর পর দুই সহযোগীসহ ইমরানের লাশ অ্যাডিস ও চুন মিশিয়ে গলে যাওয়ার জন্য সেটি নিজ বাসাতেই একটি ড্রামে ভরা হয়। পরে ড্রামের ওপরে সিমেন্টের ঢালাই দিয়ে এনায়েতবাজার রানির দিঘিতে ফেলে দেওয়া হয়। ১৩ আগস্ট লাশভর্তি ড্রামটি উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ২ সেপ্টেম্বর নগর গোয়েন্দা পুলিশ কুমিল্লার একটি মাদকাসক্ত কেন্দ্রে ছন্দবেশে থাকা অমিত মুহুরীকে গ্রেপ্তার করে। এর আগে ২০১৩ সালের ২৪ জুন নগরীর রেলওয়ে সিআরবিতে সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা সাইফুল আলম লিমন গ্রুপের সঙ্গে কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর বাবরের পক্ষের সংঘর্ষে আরমান নামে এক শিশু ও সাজু পালিত নামে এক যুবলীগকর্মী খুন হন। রেলওয়ের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েই দুপক্ষ খুনাখুনিতে জড়ায়। অমিত মুহুরী বাবরের পক্ষে এ ঘটনায় অংশ নেন। তিনি এ সংক্রান্ত মামলার অভিযোগভুক্ত আসামি।

২০১২ সালে আগ্রাবাদ জাম্বুরি মাঠে কিশোর ইমরান উল্লাহ রাসেল নামে নবম শ্রেণির এক শিশুকে খুন করেন অমিত। রাসেলের বাবা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মচারী হাবিব উল্লাহ বলেন, ছেলে মাঠে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়েছিল। পরে হাসপাতালে এনে ভর্তি করি। সেখানে চিকিৎসাধীন রাসেল মারা যায়। ২০১৬ সালে রিয়াজউদ্দিন বাজারের জনতা মার্কেটে নাজিমউদ্দিন খুন, ২০১৭ সালে একই এলাকায় সিটি কলেজের ছাত্র ইয়াসির খুন এবং বাকলিয়ায় গুলিতে ছাত্রলীগ নেতা তানজীর খুনের মামলার অভিযোগভুক্ত আসামি অমিত মুহুরী। জানা যায়, ২০১৭ সালের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে ডিসি হিল এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা চালান অমিত। এ ঘটনায় পুলিশ ২৮ এপ্রিল তাকে গ্রেপ্তার করে। ২৬ জুন জামিনে বের হয়ে আসেন। এর এক মাস যেতে না যেতেই বন্ধু ইমরানকে খুন করেন তিনি। পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সম্প্রতি চট্টগ্রামে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান ছিল অমিত মুহুরীর। ধারাবাহিক হত্যাকা-ের পাশাপাশি তার পৈশাচিক আচরণের কারণে নিজ দলের কর্মীরাও তার নাম শুনলে তটস্থ থাকতেন। যুবলীগের কেন্দ্রীয় উপঅর্থসম্পাদক হেলাল আকবর বাবরের সঙ্গেই ছিল তার সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা। অভিযোগ রয়েছে, অমিত মুহুরীকে ব্যবহার করেই চট্টগ্রামের রেলওয়ের দরপত্রের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে পরিণত হন বাবর।