দেশের মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের মানুষ নয়,যারা অর্থনৈতিক অপশাসনের সুবিধাভোগী, নতুন অর্থবছরের বাজেট তাদেরই সুবিধা দেবে বলে মনে করছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডি।

এ গবেষণা সংস্থার সম্মানিত ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেছেন,একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে গরিব মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে কাজ করার যে প্রতিশ্র“তি ছিল, তার প্রতিফলন তিনি এ বাজেটে দেখছেন না।

বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ আগামীতে পৌঁছে দেওয়ার যে অঙ্গীকার নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল, তা পূরণের স্পষ্ট কোনো রূপরেখা বা কর্মসূচি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রথম বাজেটে রাখা হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন দেবপ্রিয়।

তিনি বলেছেন, এ বাজেট স্বচ্ছল উচ্চ আয়ের মানুষকে অনেক বেশি সুবিধা দিচ্ছে। গরিব মানুষের জন্য প্রান্তিকভাবে এক ধরনের একটা ববস্থা থাকছে।বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত, বিকাশমান মধ্যবিত্ত,নিম্ন মধ্যবিত্ত- এ থেকে খুব বেশি উপকৃত হবে না।

সমৃদ্ধ আগামীর প্রত্যাশা সামনে রেখে আওয়ামী লীগের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বছরে পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের সামনে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

এই ব্যয়ের মধ্যে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা রাজস্ব হিসেবে আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী, যা মোট বাজেটের ৭২ শতাংশ।

তার এই পরিকল্পনায় আয় ও ব্যয়ের ঘাটতি থাকছে প্রায় এক লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণে ওই ঘাটতি পূরণের আশা করছেন কামাল।

তিনি মনে করছেন, এই বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারলে মূল্যস্ফীতি ৫.৫ শতাংশের মধ্যে আটকে রেখে আগামী অর্থবছরে ৮.২০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায়।

রেওয়াজ অনুযায়ী শুক্রবার সকালে গুলশানের একটি হোটেলে সেই বাজেট প্রস্তাবের বিষয়ে সিপিডির পর্যালোচনা তুলে ধরেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য।

তিনি বলে, দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, কিন্তু গরীব মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সক্ষমতা বাড়ছে না। বরং আয় বৈষম্য, ধনের বৈষম্য, ভোগের বৈষম্য বাড়ছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এটা আরও প্রকট হচ্ছে।

যারা অর্থনৈতিক অপশাসনের সুবিধাভোগী, এই বাজেট এবারও তাদের পক্ষেই গেছে। কারণ পরিবর্তনের জন্য যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার বা অর্থনৈতিক কৌশল প্রয়োজন, তা বাজেটে নেই, অথচ তা ইশতেহারে ছিল। এটাই পরিতাপের বিষয়।

দেবপ্রিয়র মতে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে ধরনের চাপ এই মুহূর্তে সরকারের আছে, সেই চাপের স্বীকৃতি অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় নেই।

যেহেতু সমস্যাটারই স্বীকৃতি নাই, সেহেতু উনারা কোনো অভিনব কৌশল খোঁজেননি।মুদ্রানীতির ভেতরে, বাণিজ্যনীতির ভেতরে অথবা ভর্তুকি বিতরণের ক্ষেত্রে- কোনো ক্ষেত্রেই সেই ধরনের অভিনবত্ব নাই।

অর্থাৎ উপস্থাপনার ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী যে ধরনের অভিনবত্ব দেখিয়েছেন, উনার বাজেট প্রস্তুতের এবং প্রস্তাবনার ভেতরে সেই অভিনবত্বটা আমরা দুঃখজনকভাবে খুঁজে পাইনি।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশহারে কী কী ছিল, বাজেটে তার কোন বিষয়ে কী আছে- সেই আলোচনা তুলে ধরা হয় সিপিডির পর্যালোচনায়।

দেবপ্রিয় বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি ধরে ধরে এ বাজেট তৈরি করেছে বলে সিপিডি মনে করতে পারছে না।

গৎ বাঁধা কিছু ভালো কথা থাকে, সেই কথাগুলো আছে। সেই কথাগুলো যখন আছে, সেগুলোর আবার কর্মসূচি নেই।

এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী তিন কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনার কথা বলেছেন। কিন্তু কোন খাতে কত দিনে কতজন করে কাজ পাবে- তার কোনো প্রাক্কলন বাজেটে নেই।

বাজেটে বলা হয়েছে করদাতার সংখ্যা এক কোটিতে উন্নীত করা হবে। কিন্তু কত বছরে, কীভাবে তা হবে এবং তার মাধ্যমে কত টাকা রাজস্ব আসবে- সে বিষয়ে কোনো রূপরেখাও বাজেটে নেই বলে মন্তব্য করেন সিপিডির সম্মনীয় ফেলো।

তিনি বলেন, বাতাসের ভেতরে কিছু আশ্বাসের বাণী হয়ত গেছে। আমরা মনে করি না সে রকম বাস্তবভাবে সেগুলো এসেছে।

বাজেট নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আর অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যের মধ্যে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার তফাৎ পাওয়ার কথা বলা হয় সিপিডির বাজেট পর্যালোচনায়।

ফলে বাজেট নিয়ে স্বচ্ছতার অভাব থেকে যাচ্ছে মন্তব্য করে দেবপ্রিয় বলেন, যদি রাজস্ব বোর্ডের তথ্যগুলো ব্যবহার করেন, তাহলে অবশ্যই ভালো দেখা যাবে হারগুলো। যদি অর্থ মন্ত্রণালয়েরটা ব্যবহার করেন, তাহলে হার কম দেখা যাবে। মন্ত্রী মহোদয় বোধহয় বিচক্ষণতার সাথে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেরটাই ব্যবহার করেছেন।

তথ্যের সামঞ্জস্যহীনতার উদাহরণ দিতে গিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, ট্যাক্সের যে উৎসে কর কাটা হবে, সেটার স্ল্যাবগুলো কী হবে, সেটা বক্তৃতার ভেতরে আছে ২৫ লাখ টাকা। আর এনবিআর হিসাব দিয়েছে ১৫ লাখ টাকা। এখানে সমস্যা রয়ে গেছে। তথ্য উপাত্তের নিশ্চয়তা নিরূপণ করেন এবং সামঞ্জস্য বিধান করেন, বাজেটে আরও স্বচ্ছতা নিয়ে আসেন।

বাজেটের আকার বৃদ্ধি এবং রাজস্ব আদায় বাড়ানোর পরিকল্পানা নিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, আগের অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটকে ভিত্তি করে নতুন অর্থবছরের বাজেট পরিকল্পানা সাজানো হয়। কিন্তু জুন মাসে যখন অর্থবছর শেষ হয়, তখন বাস্তবায়নে অনেক পিছিয়ে থাকতে হয়।

বাজেটের আকার টাকার অংকে বাড়লেও জিডিপির অনুপাতে বাড়েনি। লক্ষ্যমাত্রার সাথে বাস্তবায়নের পার্থক্য বেড়ে যাচ্ছে। বাজেটে ঘাটতি ৫ শতাংশের ওপরেই আছে।এবার সেটা বাড়বে কি না রাজস্ব আহরণের ওপর নির্ভর করবে।

জনপ্রশাসনে এবার কেন মোট বাজেটের ৪.৬ শতাংশ বরাদ্দ রাখতে হল, সেই প্রশ্ন তুলে দেবপ্রিয় বলেন, দায় দেনা পরিস্থিতি গুরুতর আকার নিতে পারে বলে আমরা মনে করছি।

ব্যাংকিং খাতের ভূমিকার ক্ষেত্রে নতুন কিছু পাচ্ছি না। বৈদেশি আয়-ব্যয়ে ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে, বাজেটে সেই বিষয়ে কোনো সচেতনতা লক্ষ্য করছি না।

আর্থিক খাতের সংস্কার, ব্যাংক খাতের সুশাসন, পুঞ্জিভূত খেলাপি ঋণনিয়ে এবারের বাজেটে কী পরিকল্পনা থাকছে, তা ছিল এবার বাজেটের আগে অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টদের আগ্রহের বিষয়।

অর্থমন্ত্রী কামাল এ বিষয়ে তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা সুদৃঢ় কার জন্য একটি ব্যাংক কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা আমরা দীর্ঘদিন শুনে আসছি। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।

মন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করে দেবপ্রিয় বলেন, ব্যাংকিং খাতেকে একটা আলোচ্য বিষয় বানিয়ে দিল! সেটার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে আলোচনায় সময়ক্ষেপের ভেতরে চলে গেল আর কি। পুরো জিনিস ব্যাংক কমিশনের বিষয়। কোনো সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃতিতে আসল না

অনেক প্রকল্প অসমপ্ত রেখে প্রস্তাবিত বাজেটে শত শত নতুন প্রকল্প না ঢোকানোয় অর্থমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানান সিপিডির ফেলো।

কিন্তু সারচার্জের ক্ষেত্রে সম্পদশালীদের যে ছাড় দেওয়া হয়েছে তা সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে মেলে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সম্পদের পরিমাণ আড়াই কোটি টাকার নিচে হলে সার চার্জ দিতে হত না। অর্থমন্ত্রী এখন সেই সীমা বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা করার কথা বলেছেন।

ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট কেনা এবং ভবন নির্মাণে বিনিয়োগের মত অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রেও বাজেটে কালো টাকা সাদা করার যে প্রস্তাব রাখা হয়েছে, সে বিষয়েও কথা বলেন দেবপ্রিয়।

তিনি বলেন, অঘষোতি আয় ও বেআইনি আয়কে আলাদা করার সময় এসেছে।

অন্যদের মধ্যে সিপিডির ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান ছাড়াও সংস্থাটির অন্য কর্মকর্তা ও গবেষকরা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।