প্রায় পাঁচ বছর আগে ২০১৪ সালে বেইজিং সফর করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঢাকায় আসেন। এর মধ্যে উচ্চপর্যায়ের সফর কম হলেও গত তিন বছরে পানি গড়িয়েছে অনেকদূর। অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অবস্থায় এসেছে অনেক পরিবর্তন।

চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ উত্তেজনাকর পর্যায়ে পৌঁছেছে, নরেন্দ্র মোদি গতবারের থেকে অধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করেছেন, পরপর তৃতীয়বারের মতো শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেছেন, বাংলাদেশের একজন মন্ত্রী প্রকাশ্যে প্রথমবারের মতো একটি চীনা কোম্পানির বিরুদ্ধে ঘুষ প্রদানের অভিযোগ করেছেন এবং সর্বোপরি রোহিঙ্গা সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী আগামী ১ জুলাই বেইজিং যাচ্ছেন, যেখানে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানোর জন্য তৈরি চীন।

সরকারের একজন কর্মকর্তা বলেন, চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের ফিরতি সফর এটি। এই সফরের উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সম্পর্ককে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সংকট, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পাবে। অন্যদিকে শি জিনপিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে ঢাকার আরও বেশি সম্পৃক্ততা চাওয়া হতে পারে বলে জানান তিনি।তিনি আরও জানান, ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্টের সফরের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করা হবে এবং ওই সময়ে দুই পক্ষের সম্মতিতে যে প্রকল্পগুলো হাতে নেওয়া হয়েছে তার দ্রুত বাস্তবায়নে বাধা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। ওই সময়ে ২০০০ কোটি ডলার ব্যয়ে ২৭টি প্রকল্প ২০১৬-২০ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য দুই পক্ষ সম্মত হয়েছিল, কিন্তু এরমধ্যে মাত্র ৪৩০ কোটি ডলার ব্যয়ে পাঁচটি প্রকল্পের কাজ শুরুর জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে দুই দেশ।

বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং ঝু বলেন, চীনের কাছে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। আমরা একটি সফল সফর আশা করছি এবং উভয়পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক বিশ্বাস আরও দৃঢ় হবে এই সফরের মাধ্যমে।

উল্লেখ্য, গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পরপর তৃতীয়বারের মতো জয়ী হলে চীনা রাষ্ট্রদূতই সবার প্রথম প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে উপস্থিত হয়ে তাকে অভিনন্দন জানান ও চীনের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন বার্তা পৌঁছে দেন।

প্রধানমন্ত্রী ১ জুলাই একটি বিশেষ ফ্লাইটে চীনের উদ্দেশে রওনা হবেন। ডালিয়ানে অনুষ্ঠিতব্য ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের অনুষ্ঠানে তিনি ২ জুলাই অংশ নেবেন। পরেরদিন তিনি বেইজিংয়ে যাবেন। ৪ জুলাই চীনের প্রধানমন্ত্রী লি চেচিয়াংয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর সরকারি ভোজে অংশ নেবেন শেখ হাসিনা। শেষদিন অর্থাৎ ৫ জুলাই শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। পরে প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে দেওয়া চীনা রাষ্ট্রপতির ভোজে তিনি অংশ নেবেন।

এখন পর্যন্ত ছয়টি চুক্তি দুইপক্ষ চূড়ান্ত করেছে এবং আশা করা হচ্ছে এবারের সফরে সেগুলো স্বাক্ষর হবে। এরমধ্যে তিনটি বিদ্যুৎ বিভাগ সংক্রান্ত, একটি সাংস্কৃতিক চুক্তি, একটি কারিগরি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি ও শেষেরটি ব্রহ্মপুত্র নদীর পানির তথ্য বিনিময় সংক্রান্ত চুক্তির নবায়ন।

২০১৬ সালে শি জিনপিংয়ের সফরের সময়ে উভয়পক্ষ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে কৌশলগত পর্যায়ে উন্নিত করেছে। ওই সফরে অর্থনৈতিক একটি কাঠামোর মধ্যে থেকে উভয় দেশের জন্য লাভজনক একটি অবস্থায় পৌঁছানোর জন্য উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর, চায়না হারবার, রোহিঙ্গা ইস্যু এবং বেল্ট অ্যান্ড রোডের উদ্যোগে যতটুকু আশা করা হয়েছিল তার থেকে আপাত দৃষ্টিতে কম অংশগ্রহণসহ অন্যান্য অমীমাংসিত বিষয়গুলো এই সফরে প্রভাব ফেলতে পারে।

উভয় দেশ সোনাদিয়া বন্দর নির্মাণের বিষয়ে একমত হয়েছিল, কিন্তু ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময়ে ওই চুক্তি সই হয়নি। পরে মাতারবাড়িতে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য জাপানকে কাজ দেয় বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এবং বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাই আবুল মাল আবদুল মুহিত চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি কর্মকর্তা ঘুষ দিয়েছে বলে প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন এবং কালো তালিকাভূক্ত করা হয়েছে।২০১৭ সালে বেল্ট অ্যান্ড রোডে উদ্যোগের প্রথম শীর্ষ সম্মেলনে পররাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রীসহ বাংলাদেশের ছয় জন কেবিনেট সদস্যকে দাওয়াত দেওয়া হলেও তৎকালীন শিল্পমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি ছোট দল পাঠায় বাংলাদেশ।

একজন কর্মকর্তা বলেন, চীন বর্তমানে একটি বৈশ্বিক শক্তি এবং এর একটি দৃঢ় প্রতিবেশী নীতি আছে।তিনি বলেন, এই অঞ্চলে চীন তার প্রাধান্য বজায় রাখতে চায়, এটি কোনও গোপন বিষয় নয় এবং এটি অর্জনের জন্য বেইজিং কূটনীতির মাধ্যমে কোমল পন্থা অবলম্বন করে থাকে।

আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা বিষয়টি আন্তর্জাতিকীকরণের বিপক্ষে আছে চীন এবং ঢাকাকে এ বিষয়ে একাধিকবার অনুরোধও করা হয়েছে। কিন্তু, বস্তুতপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিমিন্যাল কোর্ট ও আন্তর্জাতিক কোর্ট অব জাস্টিসসহ অন্যান্যরা এ বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পরেছে বলে তিনি জানান।তিনি বলেন, আমরা আশা করবো রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য চীন যে ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সেটি তারা অব্যাহত রাখবে।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলি বেইজিং সফরে গেলে চীন ওই ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং মিয়ানমারসহ তিন পক্ষ বৈঠক করে।