নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে। ২৮৩ পৃষ্ঠার দীর্ঘ রায়ে বেশকিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন আদালত। পর্যবেক্ষণে নদী দখলদার ও নদী ভরাটকারিকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত ।

সোমবার (১ জুলাই) সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে এ রায় প্রকাশ হয়।এর আগে গত ৩ ফেব্র“য়ারি নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে উল্লেখ করেন হাইকোর্ট।

আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেন, মানুষের জীবন-জীবিকা নদীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানবজাতি টিকে থাকার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে নদী। নাব্যতা সংকট ও বেদখলের হাত থেকে নদী রক্ষা করা না গেলে বাংলাদেশ তথা মানবজাতি সংকটে পড়তে বাধ্য। নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সরকার আইন প্রণয়ন করে নদীকে বেদখলের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করছে। নদী রক্ষায় আন্তর্জাতিকভাবে জাগরণ শুরু হয়েছে। এখন সবারই ভাবনা, পরিবেশের জন্য নদী রক্ষা করতে হবে।

রায়ে বলা হয়েছে, পরিবেশ, জলবায়ু, জলাভুমি, সমুদ্র, সমুদ্র সৈকত, নদ-নদী, নদীর পাড়, খাল-বিল, হাওর বাওর, নালা, ঝিল এবং সকল উন্মুক্ত জলাভূমি, পাহাড়-পর্বত, বন, বন্যপ্রাণী এবং বাতাস। এসব যেহেতু পাবলিক ট্রাস্ট সম্পত্তি তথা জনগণের সম্পত্তি। সেহেতু উক্ত সম্পত্তি দখল এবং দূষণকারী হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বাংলাদেশের সকল ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, জেলা পরিষদ এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীর অযোগ্যতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে আগামী ৬ মাসের মধ্যে ওই বিভাগকে হলফনামা দিয়ে অবহিতকরণের জন্য নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেওয়া হলো।

রায়ে হাইকোর্ট তুরাগ নদকে লিগ্যাল পারসন (আইনগত ব্যক্তি) ঘোষণা করে বলেন, অবৈধ দখলদাররা প্রতিনিয়তই কম-বেশি নদী দখল করছে। অবৈধ স্থাপনা তৈরি করায় সংকুচিত হয়ে পড়ছে নদী। এসব বিষয় বিবেচনা করে তুরাগ নদকে লিগ্যাল/জুরিসটিক পারসন হিসেবে ঘোষণা করা হলো।বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।

মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) করা রিট মামলায় এই রায় দেওয়া হয়। আদালতে রিট আবেদনকারীর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।

গাজীপুরের তুরাগ নদের টঙ্গী কামারপাড়া সেতুর দুই পাশে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দখল করাকে কেন্দ্র করে এইচআরপিবির করা এক রিট আবেদনে এ রায় দেওয়া হয়।

আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের বলেন, এর মধ্য দিয়ে মানুষের মতোই নদীর মৌলিক অধিকার স্বীকৃতি পেল। নদী যাতে জীবন্ত থাকতে পারে, দখল বা দূষণ না হয় সে জন্য একটা মেসেজ দিতে যাচ্ছেন আদালত। ভবিষ্যতে আর কেউ যেন নদী দখলের সাহস না করে।নদী রক্ষায় বিভিন্ন দেশের আদালতের দেওয়া রায়ের উদাহরণ দিয়ে হাইকোর্ট বলেন, আমাদের দেশের সব নদীকে রক্ষা করার সময় এসেছে। যদি তা না করতে পারি তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

রায়ে বলা হয়, ঢাকার চারপাশে বহমান চার নদী রক্ষায় এর আগে আদালত থেকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া না হলে এত দিনে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর হয়তো বহুতল ভবন দেখা যেত। অথবা তুরাগ নদে অবৈধ দখলদারদের হাউজিং এস্টেট থাকত।আদালত আক্ষেপ করে বলেন, এত রায় ও নির্দেশনার পরও তা সঠিকভাবে বাস্তবায়নে বিবাদীরা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আদালতের নির্দেশনা সঠিকভাবে প্রতিপালন হলে তুরাগ নদ রক্ষায় হাইকোর্টে আরেকটি মামলা করতে হতো না।

আদালত বলেন, শুধু যে তুরাগ নদই আক্রান্ত তা নয়; গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনাসহ দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ৪৫০টি নদ-নদীও অবৈধ দখলদারদের দ্বারা আক্রান্ত। এখন এসব নদী রক্ষায় আমরা (আদালত) কি হাজারখানেক মামলা করার ব্যাপারে উৎসাহ বা অনুমতি দেব? নাকি অবৈধ দখলের হাত থেকে নদী রক্ষায় এই মামলা ধরে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেব? যে নির্দেশনার আলোকে নদী দখলমুক্ত করার মামলা আর আদালতের সামনে আসবে না?