অধিকাংশই নন ভোটার। বয়সে কিশোর, তরুণ কিংবা মাত্র যুবক। দৃশ্যমান কোন আয় নেই। তাতে কী। ঘুরে বেড়াচ্ছে দুই/তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকার মোটরসাইকেলে। একক কেউ নয়। এদের রয়েছে আবার বহর। বেপরোয়া, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কলাপাড়ার অলিগলি। গ্রামীণ জনপদে এটি এখন আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। পর্যটন সমৃদ্ধ কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটা, মৎস্য বন্দর মহিপুর-আলীপুর, পায়রা তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র এলাকা কিংবা পায়রা সমুদ্র বন্দর এলাকায় শত শত এমন মোটরসাইকেল বহরের দাপানো দৃশ্য নিত্য চোখে পড়ে। নেই এদের ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ বৈধ কাগজপত্র। এদের পরিচয় শণাক্তে গলদঘর্ম হতে হয়।

এরা এখন সাধারণ মানুষের আতঙ্কে পরিনত হয়েছে। এদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে মানুষ। চাঁদাবাজি এবং দখল বাণিজ্য এ বাহিনীর প্রধান কাজ। এচক্রের দৌরাত্ম বন্ধ করতে না পারলে বরগুনার বন্ড বাহিনীর মতো কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনার শঙ্কায় রয়েছেন সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে বেশি বিপাকে রয়েছেন আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মী আর সমর্থক। সাগরপারের বিস্ময়কর উন্নয়নের জনপদে এই মোটরসাইকেল বাহিনীর চলনের শব্দ মানুষকে তটস্থ করে তোলে। আন্ধারমানিক নদী তীরের কলাপাড়া শহরটির মানুষকে উৎকন্ঠায় রাখছে মোটরসাইকেল বাহিনীর ক্যাডাররা। মহিপুর, কুয়াকাটাসহ প্রত্যেকটি ইউনিয়নে এমন বাহিনীর দাপানো দৃশ্য বিরাজমান।
কলাপাড়া পৌরশহরে পহেলা জুলাই রাতে এ বাহিনী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা এসএম রাকিবুল আহসানের এতমিখানার বাসার সামনে এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ করা হয়। ১৫/১৬ মোটর সাইকেলযোগে আসা সশস্ত্র সন্ত্রাসী এ কান্ড ঘটনায়। এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা প্রতিবাদসভা মিছিল ও সংবাদ সম্মেলন করেন। কলাপাড়া থানায় জিডি করা হয়েছে। একই সন্ধ্যায় মিঠাগঞ্জের জয়বাংলা বাজারে রাজিব মুসল্লী নামের এক যুবককে রাম দায়ের উল্টোদিকের আঘাতে জখম করে মোটরসাইকেল বাহিনী। অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়া হয় অপর এক কৃষকের জাল। রমজানপুর গ্রামের দরিদ্র পরিবারের ১২ বছরের এক কিশোরীকে জঙ্গলে নিয়ে মুখ চেপে ধর্ষণ করা হয়। ২৭ জুনের ঘটনা। এখানেও মোটরসাইকেলে চড়ে গিয়ে বর্বর কান্ড ঘটায় এক বখাটে।

সম্প্রতি চাকামইয়ার এক নববধূকে বাড়ি থেকে অপহরণ করে পাশের বিলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। সেখানেও মোটরসাইকেল ব্যবহার করে নরপশুর দল। ধুলাসারে গণধর্ষণকারীরা মোটরসাইকেল যোগে এক গৃহবধূকে ঘর থেকে বিলে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় ব্যবহার হয় মোটর সাইকেল। এখন গ্রাম কিংবা শহরের মানুষের কাছে মোটরসাইকেল যানটি একটি আতঙ্কের নাম। এমনকি কোন স্লুইস গেটে কে জাল পেতে মাছ ধরবে তাও মোটর সাইকেল বাহিনী নিয়ন্ত্রন করছে। মানুষের কাছে এ বাহিনী এখন মুর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। সবশেষ মিঠাগঞ্জের তেগাছিয়া-মধুখালী সড়কের একটি ছোট্ট কালভার্টে জাল পেতে জীবিকা নির্বাহ করা হতদরিদ্র সোবাহান-নাজমা দম্পতির ওপর ১৫/১৬ মোটরসাইকেল যোগে আসা সন্ত্রাসী বাহিনী হামলা চালায়। এখন এ পরিবারের অষ্টম শ্রেণি পড়–য়া খোকন নামের এক শিক্ষার্থীর স্কুলে যাওয়া বন্ধ রয়েছে। জীবন-জীবিকা বন্ধের শঙ্কায় ওই পরিবারের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। সরকারের হেল্পলাইন “৯৯৯” তে কল করে এ পরিবার পুলিশি সহায়তায় প্রথম দফা রক্ষা পেয়েছে। বর্তমানে মোটরসাইকেল বাহিনীর দাপানোর ঘটনায় সরকারি দলের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে। থানা-পুলিশ এদের কাউকে এখন পর্যন্ত আটক করতে সক্ষম হয়নি। পাখিমারায় মোটরসাইকেল বাহিনী এখন ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। দোকানি থেকে সাধারণ মানুষ মোটরসাইকেল বাহিনীর হর্ণের শব্দ শুনলেই কোন না কোন শঙ্কায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অভিযোগ নব্য এক শ্রেণির বখাটে অনুপ্রবেশকারী সরকারি দলের কারও কারও ছত্রছায়ায় মোটরসাইকেল বাহিনী গড়ে নিজেদের আখের গোছানোর কাজ করছে। আর ভিকটিম হচ্ছে সাধারণ মানুষসহ আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী-সমর্থক। স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ মহিব্বুর রহমান মহিব বিভিন্ন সভা-সমাবেশে সন্ত্রাসী, মাদক সংশ্লিষ্ট কিংবা কোন চাঁদাবাজ কেউ থাকলে তার বিরুদ্ধে পুলিশকে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দৃঢ় ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু কার্যত এর সুফল মিলছেনা। মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। উপজেলা আইন-শৃঙ্খলার একাধিক সভায় এসব বিষয় নিয়ে অসংখ্য আলোচনা হয়েছে। নেয়া আছে সিদ্ধান্ত। কিন্তু মানুষকে স্বস্তি দিতে পারছে না।
কলাপাড়ায় সরকারের বিস্ময়কর উন্নয়নে বদলে গেছে চিত্রপট। রাস্তাঘাটসহ বিদ্যুত পৌছে গেছে অধিকাংশ গ্রামে। যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। জমিজমার দাম বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সুযোগে খাস ও বিরোধীয় জমির দখলকে ঘিরে এক শ্রেণির সালিশবাজ গড়ে উঠেছে। দখলবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে। কাগজপত্রের ত্রুটিকে কেন্দ্র করে একটি সুযোগ সন্ধানি গ্রুপ তৈরি হয়েছে। জাল-জালিয়াতি চক্র প্রস্তুত রয়েছে। এসব কেন্দ্রীক দখল-উদ্ধার কিংবা পাল্টা দখলদারিত্বের কাজে ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি হয়েছে। সরকারি দলের কতিপয় স্বঘোষিত ক্যাডার বাহিনীর সমন্বয়ে এচক্র গড়ে উঠেছে। এ বাহিনী সকল কাজে ব্যবহার করছে মোটরসাইকেল। এমনকি মাদক বেচাকেনার কাজেও ব্যবহার হচ্ছে রাত-দিন এ বাহনটি। কলাপাড়ার বিভিন্ন এলাকায় ২০-২৫টি স্পটে রয়েছে ভাড়াটে মোটর সাইকেল স্ট্যান্ড। স্ট্যান্ড ভিত্তিক নির্দিষ্ট পোশাক ও আইডি কার্ড বহনের বিষয়টি নিশ্চিত থাকলে শণাক্ত করা যায় কোন অপরাধী এদের মধ্যে থাকছে কি না। এছ্ড়াা বৈধ কাগজপত্রবিহীন মোটরসাইকেল চালানো বন্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হলেও এমনসব বখাটে অপরাধীচক্রের দাপিয়ে বেড়ানো কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণে থাকত। এমনকি রাত ১০টার পরে গ্রামীণ জনপদে এ যানটি বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া চলাচল করতে পারবে না বলে জনপ্রতিনিধিরা দাবি করেছেন। তাও নিশ্চিত করা হয়নি। বর্তমানে এ জনপদে মোটর সাইকেল বাহিনী সাধারণ মানুষের স্বস্তি কেড়ে নিচ্ছে। মানুষ তটস্থ হচ্ছে এ বাহিনীর হর্ণের শব্দে। নিয়ন্ত্রণে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি সকলের। এ বাহিনীর কারণে প্রাণঘাতি কোন অঘটনের শঙ্কা করছেন মানুষ। কলাপাড়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মুনিবুর রহমান এবং কলাপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ মনিরুল ইসলাম জানান, মোটরসাইকেল যদি কেউ কাগজপত্রবিহীন ব্যবহার করলে তাকে আইনের আওতায় নেয়া হবে। আর যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থার গ্রহণের কথা জানালেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।