মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে যাবার পর নতুন করে না ঘুমিয়ে লিখতে বসেছি। ভাবছি ঘুমের মত এমন একটি মুহুর্ত তাকে কি কখনও আমি উপলদ্ধি করতে পেরেছি? ক্লান্ত সময়ের এক বিপরীত মুহুর্ত ঘুম। ক্লান্ত হলে তো আমরা বিশ্রাম নিতে পারি কিন্তু না ঘুমালে বিশ্রামের সেই পরিপূর্ণতা কি লাভ করা সম্ভব? হয়ত না।

ছোটবেলায় সন্ধ্যা হবার সাথে সাথে যে ঘুম পেতো তেমন ঘুম এখন আর পায় না। সে যে কি ঘুম! তার বর্ণনা দেবার নয়, তবে সেই অনুভূতি আজও মনের মাঝে গাঁথা রয়েছে। এখনকার ঘুম বেশ হালকা পাতলা, কোন রকম শব্দ হলেই ব্যাস গেলো ঘুমের বারোটা বেজে। তবে মজার ব্যাপার হলো বাস, ট্রেন বা প্লেনে উঠলেই আমার প্রথম যে কাজ তা হলো ঘুম।

দুটো পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। একবার বাংলাদেশে, ঢাকা থেকে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছি। পায়ে সুন্দর এক জোড়া নতুন জুতা। বাসে বসতেই বড্ড ঘুম পেয়েছে। ছিট গুলো বেশ খালি, তো আমি দিব্যি ঘুমিয়ে গেছি। ফরিদপুর এসেছি, হঠাৎ একজন নতুন যাত্রী বাসে উঠে আমাকে আমার পা নিচে নামাতে বললো। চোখ খুলে দেখি ময়লা একটি জুতা পায়ে, ঘুমের ঘরে লোকটিকে বললাম -‘ওটা আমার পা নয়’! লোকটা একটু রেগে বললো, ‘এই ছেলে ইয়ার্কি হচ্ছে? পা সরাও বলছি’।তাড়াতাড়ি পা সরিয়ে দেখি ওমা এ তো আমার পা! তবে জুতা তো আমার না। জুতা চোর কখন পথে আমার নতুন জুতা পাল্টে পুরনো জুতা পায়ে পরিয়ে ভেগেছে তার কিছুই জানিনে।

আরেকবার সুইডেন থেকে লন্ডনের গ্লাসগোয় আমাদের একটি অফিসিয়াল মিটিংয়ে যাবার ঘটনা। আমার অফিস থেকে আমরা ১০জন স্টকহোম থেকে রওনা দিয়েছি। আমার পাশে বসেছে সদ্য চাকরিতে যোগ দেয়া কারিনা হ্যানসন। কারিনা ভেবেছিল সে এই দুই ঘন্টার পথে আমার সাথে পরিচিত হবে। দুঃখের বিষয়, প্লেন ল্যান্ড করতে যখন ১০ মিনিট বাকি ঠিক তখন ঘুম ভাঙ্গতেই কারিনা বলেছিল ‘-রহমান তুমি আমার ঘাড়ের উপর ঘুমিয়ে দুই ঘন্টা পার করেছ।’ একটু লজ্জিত হয়েছিলাম সেদিন কারণ মেয়েটি আমার অফিসে নতুন জয়েন করেছে। প্রথমে সবাই বিষয়টি নিয়ে একটু আলোচনা করেছিল। আমার কি অন্য কোন মতলব ছিলো? না, ছিলো না। কারণ ঘুমই একমাত্র মতলব ছিল সেদিন, তাই প্লেনে বসতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

সিনেমায় গেলেও পাঁচ মিনিট যেতেই আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যাই। জেমস বন্ডের ছবি চলছে আর আমি গভীর নিদ্রায় মগ্ন। আবার নতুন কোথাও গেলে প্রথম রাতে চোখে ঘুমের বালাই নেই। জানিনে কেন এমনটি হয়। হয়ত নতুন পরিবেশের কারনে ঘুম ভালো হয় না।

ঘুম আমাদের মনকে সবল এবং প্রফুল্ল করে। মানসিক শান্তি নিয়ে আসে, ক্লান্ত সময়ে দেহে নিয়ে আসে প্রশান্তি। দেহ মনকে চাঙ্গা করে তোলে যে জিনিসটা সেটা হলো এই ঘুম! ঘুম আমাদের চিন্তা চেতনার উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। শৈশব এবং কৈশর জীবনে ঘুমের দরকার সবচেয়ে বেশি কারন শরীরের যথাযত বৃদ্ধিতে ঘুমের দরকার অপরিসীম। বয়স্ক বা বার্ধক্যে ঘুমের দরকার তবে অতিরিক্ত ঘুমের দরকার পড়ে না। দিনের এক তৃতীয়াংশ সময় আমরা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিই। অনেকের ধারণা এটা সময়ের একধরণের অপচয়, কিন্তু বাস্তবে তা নয়।

ক্রিয়েটিভ চিন্তার জন্য দরকার ঘুমের। ঘুম শরীর পূর্নগঠনে সাহায্য করে। ঘুম সমস্ত শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের অবসাদ দূর করে শুধু শ্বাস-প্রশ্বাস ছাড়া। বয়স হয়েছে ঘুম এখন আর ছোটবেলার মত নেই। রাতে অনেক সময় ঘুম ভেঙ্গে যায় বারে বারে আর তখন মনে পড়ে অনেক কথা। জীবনের কথা, ভালো মন্দের কথা, প্রেম প্রীতির কথা বা ইতি কথা।

মায়ের কোলে শিশুর ঘুম যেমন নিশ্চিন্তের জীবন গড়ার স্বপ্নের জাল যা মায়ের প্রতিক্ষার এক অপেক্ষা। শৈশব এবং কৈশরের দুরন্তপনা আর সারাদিনের দুষ্টমির পরে সন্ধ্যার ঘুম, প্রভাতে রবি উঠার আগে ঘুম থেকে উঠে জীবন গড়ার এক মধুময় স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার প্রচেষ্টা। যৌবনে উদীয়মান ক্লান্ত সময়ে বিশ্রামের জন্য ঘুম, যে ঘুম ক্লান্তিকে দূর করে, জেগে জেগে দেখা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সাহায্য করে। ঘুম জীবনের এক অজানা অতিরিক্ত আবেগ অনুভূতি, যা তার গোপন এক প্রাকৃতিক নিরাপত্তা। যৌবনে ঘুমন্ত অবস্থার সাথে বার্ধক্যের ঘুমন্ত অবস্থার পার্থক্য হল এ সময় মানুষের উত্তেজনায় সাড়া দেবার ক্ষমতা (রিফ্লেক্স) হ্রাস পায়।

গ্রাম বাংলায় চৈতালি রাতে দখিনা হাওয়ায় ঘুম সেটাও তো কখনও ভুলবার নয়। কিংবা উত্তর গোলার্ধের গ্রীষ্মে মাঝ রাতে যখন ঘুম ভেঙ্গে যায়, ব্যালকনির দরজা খুলে বাল্টিক সাগরের পানিতে চাঁদের আলোকে দেখে আবার ফিরে সহধর্মীনির পাশে এসে ঘুমিয়ে পড়া, সেটাও যেন এক মধুর অনুভূতি।

জীবনের সন্ধ্যা ঘনিয়ে যাবে আর বেলা যাবে ঐ, কোথায় যাবে স্মৃতি গুলো আর হৈ চৈ! আসবে বার্ধক্য, বার্ধক্যের ঘুম জীবনের শেষ সময়ের ঘুম।যে ঘুমের পরে কখনও সকাল হবে। আবার হয়ত কখনোই সকাল হবে না। রাতের প্রদীপ নিভিয়ে ঘুমিয়ে রব শান্ত হয়ে চিরন্তন সুখের অপেক্ষায়।

রহমান মৃধা, দূরপরবাস সুইডেন