দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, ছোট গাছ উপড়ে ফেলা যত সহজ বড় গাছ উপড়ানো তত কঠিন। তাই বলে যে আমরা বড় গাছ ধরছি না, তা নয়। আমরা ধরছি। চুনোপুঁটিও ধরব, বড় মাছও ধরব।

শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীতে জাতীয় প্রেসক্লাবে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ আয়োজিত এক সেমিনারে দুর্নীতি দমনে আইনজীবী ও বিচার বিভাগের ভূমিকা শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন দুদক চেয়ারম্যান।

দুদক চেয়ারম্যান বলেন, দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ যারা দুর্নীতির কারণে কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন- তাদের কল্যাণেই চুনোপুঁটিদের আইন-আমলে আনতে হচ্ছে এবং তা অব্যাহত রাখা হবে। তবে এ কথা দৃঢ়ভাবে বলতে পারি শুধু চুনোপুঁটি নয়, রাঘব- বোয়ালদেরও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। অনেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, বিত্তবান ব্যবসায়ী কিংবা উচ্চ পদে আসীন অনেক আমলার বিষয়েও দুদক অনুসন্ধান, তদন্ত কিংবা প্রসিকিউসন করছে। ছোট গাছ উপড়ে ফেলা যত সহজ বড় গাছ উপড়ানো তত কঠিন। তাই বলে যে আমরা বড় গাছ ধরছি না, তা নয়। আমরা ধরছি। চুনোপুঁটিও ধরব, বড় মাছও ধরব। দেশের সাধারণ মানুষ যারা গ্রামে বাস করে তারাই দুর্নীতি, হয়রানি কিংবা অনিয়মের সবচেয়ে বড় শিকার। এসব দুর্নীতিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চুনোপুঁটিরাই সম্পৃক্ত থাকেন।

ইকবাল মাহমুদ বলেন, ১০ থেকে ১৫ জন সরকারদলীয় এমপি-মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুদক। অন্য এক দলের ১৫ জন, আরেক দলের ১২ জন। আরেক দলের ব্যবসা সংক্রান্ত তদন্ত ২৫ জন, ঊর্ধ্বতন আমলা সচিব থেকে শুরু করে ডেপুটি সেক্রেটারি পর্যন্ত ১৫ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুদক।

দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আসলে বৈপ্লবিকভাবে কিংবা হুট করে সবকিছু করা সম্ভব হবে না। আমরা আস্তে আস্তে ধরব। চুনোপুঁটি ধরেছি, বড় মাছও ধরা হবে। ইন ওয়ান গোয়িং ওয়ান জাম্প।আমরা এমন কিছু করতে চাই না। আমরা হাত দিলে হাত নিয়ে আসতে চাই না। হাত পুড়ে যাক, আমরা সবাই চলে যাই, তাও ভালো। যদি হাত দেই তো দেবই। যদি না পারি তাহলে দেব না। এটাই আমাদের কমিশনের ফিলোসফি।

ইকবাল মাহমুদ বলেন, আসলে সমন্বিত প্রয়াস ছাড়া দুর্নীতি রোধ সম্ভব না, মূল্যবোধসম্পন্ন বাচ্চা তৈরি করতে হবে। আমরা যদি একটা জেনারেশনকে বদলে দেওয়ার যুদ্ধে সফল হতে পারি, তাহলে তারাই হবে আমাদের অ্যাসেট।

মানি লন্ডারিং মামলা প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মানি লন্ডারিং ইস্যুটা আমাদেরই। মানি লন্ডারিং আইন সংস্কার করে শুধু ঘুষ আর দুর্নীতির বিষয়গুলো কমিশন দেখছে। এ সংক্রান্ত ২০০ মামলা তদন্ত করছে কমিশন। এর মধ্যে ২২টি মামলার ২২টিতেই শাস্তি হয়েছে। অর্থাৎ শতভাগ শাস্তি হয়েছে। ঘুষ থেকে উৎসরিত অর্থ যদি লন্ডারিং হয়, তাহলে আমরা আছি। বাকিগুলো সিআইডি, বাংলাদেশ কিংবা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর দেখছে। তবে দুদকের ওপর অনেকেরই মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত নিয়ে প্রত্যাশা বেশি। সেটা ভালো। আমরা এসব নিয়ে তিনটি রিসার্চ করছি। আমাদের ফিলোসফি রয়েছে। আমাদের দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। দুর্নীতির কারণে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর তারা কিন্তু সব অফিস-আদালতেই দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন।ইকবাল মাহমুদ বলেন, সমাজে দুই পেশাজীবী শ্রেণির গুরুত্ব অনেক বেশি। ডাক্তার শ্রেণি সরাসরি মানুষের জীবনরক্ষায় কাজ করে থাকেন। কিন্তু আইনজীবীদের ক্ষেত্রে দায়িত্ব ও গুরুত্ব আরো বেশি। কারণ, তারা জীবন, সম্পত্তি ও বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি রক্ষাতেও কাজ করে থাকেন। দুদকের মামলায় আমরা ভালো আইনজীবী নিতে চাই। এটা নিয়ে বিজ্ঞ আইনজীবীদের পরামর্শ নেওয়া হবে।

দুদকের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে চেয়ারম্যান বলেন, দুদক কিন্তু হুট করে আসেনি। আমরা যারা দুদকে কাজ করি তারাও এ সমাজেরই মানুষ, এ সমাজেরই অংশ। সমাজের অন্যান্য জায়গায় যা হয়, তা আমাদের এখানে যে হয় না, তা নয়। আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। সে দায় আমাদেরই। আমাদের তদন্তকারী কর্মকর্তাও কম। একটা প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, একজন ডেপুটি পরিচালক কিংবা সহকারী পরিচালক যখন সচিবের পদমর্যাদার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত করেন। তখন সরকারি কর্মকর্তাকে ধরতে সরকারের অনুমতি লাগে না।

দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের সমস্যা আমরা যেটা বলি সেটা বিশ্বাস করি না, যেটা করি সেটা বলি না, যেটা করি সেটা বিশ্বাস করি না। এ এক অদ্ভুত নিগড়ে আমরা বন্দি। আর এই নিগড় ভাঙতে হলে তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নৈতিকমূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষা ও মননে বিকশিত করে উন্নত মানসিকতা সম্পন্ন একটি প্রজন্ম সৃষ্টি করতে হবে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে, এটা স্বীকার করতে আমি বিব্রত নই। কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে আমার কাছে যেসব নথি উপস্থাপতি হয় তার অধিকাংশেই বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়। পুরোপুরি সক্ষমতা থাকলে আমার পর্যায়ে যেসব নথি আসে তাতে কোনো ত্রুটি থাকার কথা নয়।

ইকবাল মাহমুদ বলেন, আমি যোগদান করেই বলেছিলাম, অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্তে টাইম লাইন অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য টাইম লাইন যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না। যদিও আমরা চেষ্টা করছি।

সভাপতির বক্তব্যে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, মানুষ বিশ্বাস করে দুদক চুনোপুঁটিদের ব্যাপারে কঠোর। বিরোধী রাজনীতিকদের প্রতিও তারা কঠোর। পক্ষান্তরে সরকারি দলের প্রতি তারা দুর্বল। তবে এ কথাও ঠিক বর্তমান চেয়াম্যানের নেতৃত্বাধীন কমিশনে ক্লিন সার্টিফিকেট নেওয়ার প্রবণতা বন্ধ হয়েছে।

সম্প্রতি দুদক চেয়ারম্যানের একটি বক্তব্য সঠিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি জানিয়ে মনজিল মোরসেদ বলেন, আমি নিজে এ সংক্রান্ত একাধিক ভিডিও ফুটেজ দেখেছি কোথাও তিনি বলেননি সরল বিশ্বাসে দুর্নীতি করা অপরাধ নয়। এমনকি ওই বক্তব্যে দুর্নীতি শব্দটিই তিনি উচ্চারণ করেননি। তারপরও কেন বিষয়টি এভাবে প্রচার হলো? আসলে দায়বদ্ধতা সবারই থাকা উচিত।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু বলেন, দুর্নীতিপরায়নদের সাজা নিশ্চিত করা গেলেই সমাজে এই বার্তা পৌঁছে যাবে যে, দুর্নীতি করলে রক্ষা নেই।অনুষ্ঠানে ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম বলেন, আইন দিয়ে দুর্নীতি বন্ধ করা কঠিন, এর সঙ্গে সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের বিষয়াদি জড়িত।সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্যারিস্টার এম এস আজিম।