চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছে সাত হাজার ১৭৯ জন। এর মধ্যে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তারের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা ইউএনবি।

এদিকে, হবিগঞ্জ জেলার সিভিল সার্জন ডা. শাহাদত হোসেন (৫৩) ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত রোববার রাত ১২টায় মারা যান। তিনি ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ নিয়ে খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েই তোলপাড় শুরু হয়েছে।

হবিগঞ্জ সিভিল সার্জন অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শাহ আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।তিনি জানান, গত ৯ জুলাই ঝালকাঠি সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা থেকে পদোন্নতি পেয়ে হবিগঞ্জে জেলা সিভিল সার্জন হিসেবে যোগদান করেন ডা. শাহাদত। ঢাকায় থাকা পরিবারের সঙ্গে কিছুদিন ছুটি কাটিয়ে গত ২০ জুলাই জ্বর নিয়ে কর্মস্থলে যোগদান করেন তিনি।

শাহ আলম আরো জানান, ওই দিন দুপুরে জ্বর বেড়ে গেলে তাঁকে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাঁকে ঢাকায় পাঠান এবং রোববার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।এ নিয়ে সরকারি হিসাবমতে, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ছয়জনে দাঁড়াল।

শুধু গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৪০৩ জন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে খোদ ঢাকাতেই ৩৯৯ জন ভর্তি হয়েছেন। এ ছাড়া খুলনায় দুজন ভর্তি হয়েছে। আর ঢাকায় হেমোরজিক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন দুজন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবমতে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৮৩ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ৩৮, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ১২, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৩৩, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৪৫, বারডেম হাসপাতালে ৮, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ১৫, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৮, পিলখানা বিজিবি হাসপাতালে পাঁচ, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৯ এবং বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে ১২৩ জন ভর্তি হয়েছেন।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত সাত হাজার ৯৮ জন ভর্তি হয়েছেন। ঢাকা শহরের বাইরে ঢাকা বিভাগে এ সংখ্যা ২৮ জন। ডেঙ্গু আক্রান্ত ভর্তি রোগী চট্টগ্রামে আটজন ও খুলনায় ৩৭ জন।

তবে আশার কথা হলো, এ পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৫০৯ জন রোগী চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। সরকারি হিসাবমতে এখনো এক হাজার ৬৬৫ জন রোগী বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।

বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরো বেশি দাবি করা হচ্ছে মর্মে প্রশ্ন করা হলে হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার বলেন, সরকারি হাসপাতালের তথ্য ঠিক থাকলেও বেসরকারি হাসপাতালগুলো অনেক সময় তথ্য সরবরাহ করতে চায় না। তাই হিসাবে কিছুটা গরমিল থাকতে পারে।

এ ব্যাপারে মহাখালী রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের ডেঙ্গু-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ প্রদানের সময় কোনো ডেঙ্গু রোগী পেলে রক্ত সংগ্রহ করে তাঁদের কাছে নমুনা ও রোগী-সংক্রান্ত তথ্য পাঠাতে বলা হলেও তাঁরা পাঠাচ্ছেন না।

এ বিষয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র রায় বলেন,এ সময়ে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকেই। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে কয়েক দিনেই ডেঙ্গু পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মুক্তিযোদ্ধা ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী ইউএনবিকে বলেন, ডেঙ্গু থেকে বাঁচার মূল উপায় হলো সচেতনতা। বাসার আশপাশ পরিচ্ছন্ন রাখা, সময়মতো ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে ডেঙ্গু নিয়ে ভয়ের কিছু নেই।

ডেঙ্গু কীভাবে ছড়ায় প্রশ্ন করলে স্বাস্থ্য-শিক্ষা প্রশিক্ষক মোহাম্মদ শাহজাহান জানান, ডেঙ্গু এডিস মশার কারণে হয়। ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে সেই ব্যক্তি চার থেকে ছয় দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। এবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে।

ডেঙ্গু কীভাবে চিনব এ প্রশ্নে ডা. মাহমুদুন্নবী মাসুম বলেন, ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর এবং সেইসঙ্গে শরীরে প্রচ- ব্যথা হয়। জ্বর ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা হয়। এ ছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়। গায়ে রেশ হতে পারে। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব হতে পারে।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রিফাত হোসেন নামে একজন কর্মকর্তা জানান, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ডেঙ্গুর জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ০৯৬১১০০০৯৯৯-১ নম্বরে ফোন করে যেকোনো অধিবাসী নাম, মোবাইল নম্বর এবং ঠিকানা জমা দিলে সিটি করপোরশেনের চিকিৎসক ওই রোগীর সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়।

প্রয়োজন হলে রোগীর বাসায় চিকিৎসক উপস্থিত হন এবং প্রয়োজনীয় সেবা দেন, যোগ করেন তিনি।

এ ছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মমিন বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সচেতন করা, মসজিদের ইমামের মাধ্যমে মুসল্লিদের সচেতন করা এবং স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতন করার কর্মসূচি রয়েছে। মঙ্গলবার হট লাইন চালু করা হবে। চিকিৎসকদের একটি টিম ২৪ ঘণ্টা উপস্থিত থাকবেন এবং রোগীদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা দেবেন।