ডেঙ্গু আতঙ্ক দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। কোনও কোনও পরিবারের একাধিক সদস্য ডেঙ্গু আক্রান্ত। বেশির ভাগ হাসপাতালে পা ফেলার জায়গা নেই। নির্ধারিত বেড ছাড়িয়ে ফ্লোরে, বারান্দায়, লিফটের পাশে, বাথরুমের দরজার সামনে যে যেখানে পারছে সেখানেই বিছানা পেতে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিচ্ছেন।

রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে জেলা শহরগুলোতেও ডেঙ্গু আতঙ্ক মহামারি আকার ধারণ করেছে। কেউ শরীরে সামান্য একটু জ্বর বোধ করলেই চেক আপের জন্য ছুটে যাচ্ছেন হাসপাতালে। হতে পারে এটি সাধারণ জ্বর বা অন্য কিছু। কিন্তু বর্তমানে কেউ এটাকে সাধারণভাবে নিচ্ছেন না। কারণ এবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার কিছু সময়ের মধ্যেই সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন কেউ কেউ। তাই একটু জ্বর ওঠা মাত্রই হাসপাতালের দিকে ছুটছেন রোগীরা।

এদিকে হাসপাতালের বেডের চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরাও। বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসাপাতালে সরেজমিনে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। এখানকার চিকিৎসকদের অভিযোগ, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। কিন্তু সে পরিমাণে ডাক্তার বা নার্স নেই। এজন্য তাদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। অন্যদিকে ডেঙ্গুসহ অন্যান্য রোগী বেশি হওয়ায় তাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের মেঝে, বারান্দা, চিকিৎসকের চেম্বার এবং লিফটের সামনে থেকে শুরু করে বাথরুমের দরজা পর্যন্ত সর্বত্র রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

শত কষ্ট মুখ বুঝে সহ্য করে চিকিৎসা নিচ্ছেন ডেঙ্গু রোগীরা। এ বিষয়ে কথা হয় মিটফোর্ড হাসাপাতালের চিকিৎসাধীন েেডঙ্গু রোগী আলতাফ মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, দুইদিন আগে মিটফোর্ড হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ১-৩-৫-৭ ইউনিটে ভর্তি হয়েছি। ভর্তি হওয়ার সময় কোনো বেড পাইনি। এজন্য ফ্লোরে বেড পেতে চিকিৎসা নিচ্ছি। যেভাবে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়ছে তাতে কারও কিছুই করার নেই। সব হাসপাতালে একই অবস্থা। হাসপাতালে বেডের চেয়ে রোগী বেশি।

একই বিভাগের সিনিয়র নার্স সাথী হালদার বলেন, এই ইউনিটে ডেঙ্গু আক্রান্তসহ ১৭২ জন রোগী রয়েছে। গত ২৪ ঘন্টায় এখানে ৪৪ জন েেডঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। প্রতিদিন গড়ে ১৫-২০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন। আগের রোগীসহ নতুন রোগী যোগ হওয়ায় আমরা চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, গত ২৪ ঘন্টায় ৬/৭ জন নার্স চিকিৎসা দিয়ে আসছে। সকাল থেকে চিকিৎসক বেশি থাকলেও নাইট শিফটের জন্য মাত্র দুজন নার্সকে দিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

মিটফোর্ড হাসাপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সেখানে এখন ১৯৯ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাছাড়াও প্রতিদিন ৬৫/৭০ জন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। আর প্রতিদিন চিকিৎসা শেষে ৩০/৪০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল ছাড়ছেন।

মিটফোর্ড হাসাপাতালের ৩ নম্বর ভবনের সিনিয়র এক নার্স নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রোগীর তুলনায় ডাক্তার-নার্স অনেক কম। চিকিৎসক/নার্সের সংখ্যা বাড়ানো বিষয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বারবার জানানো হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। অন্যান্য রোগীর চেয়ে ডেঙ্গু রোগীকে বেশি সময় দিতে হয়। একটুও বিশ্রাম নেওয়ার সময় পাচ্ছি না। সত্যিই ডেঙ্গু যেন আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মাদারীপুর থেকে ছেলে সাগর আলীর (১৬) ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা করানোর জন্য লাইজু আক্তার (৪৫) মিটফোর্ড হাসাপাতালে এসেছেন। তিনি বলেন, দুইদিন আগে থেকে ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালের বারান্দায় আছি। আজকে নার্স বলেছে ভিতরে মেঝেতে সিট করে দিবে। চিকিৎসা ভালোই হচ্ছে। তবে সমস্যা হচ্ছে মানুষ অনেক বেশি।

মিটফোর্ড হাসপাতালের জরুরি বিভাগের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতি ২০ রোগীর মধ্যে তিনজন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাদের ওয়ার্ডে ভর্তি করে দেওয়া হচ্ছে। সেখানেই তাদের ভাল চিকিৎসা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গু রোগীর সঠিক সংখ্যা পেতে প্রতিটি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর হিসাব জানতে হবে। কত রোগী বহির্বিভাগ থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে যান, তা জানাও জরুরি। তারা বলছেন, ঢাকা শহরের প্রাইভেট চেম্বারগুলোর কোনও হিসাব নেই। অথচ শহরের একটি বড় অংশের মানুষ প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসা নেন। এই অংশটাও বাদ পড়ে যাচ্ছে। ৫০ শতাংশ রোগীই সরকারি নজরদারির বাইরে থাকছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের হিসাব অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৫৪৭ জন। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১১ জন। এর মধ্যে চট্রগ্রামে ৯ জন, খুলনায় ও বরিশালে ১ জন করে।

এ পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৯ হাজার ২৫৬ জন। ঢাকার ভেতরে ঢামেক হাসপাতালের নতুন ভবনের ৪, ৫ ও ৬ তলায় ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এই হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১১২। এছাড়া মিটর্ফোড হাপসাতালে ৫৮ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৬৩, শিশু হাসপাতালে ২৭, হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ৩২, বারডেমে ১০, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ১৮, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৪২ এবং বিজিবি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৭ জন।

এছাড়া ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ১৬৭ রোগী। আর বেরসকারি ৩৬টি হাসপাতালে বর্তমানে ভর্তি আছেন ৯৩১ জন। বেসরকারি হাসপাতালে এ পর্যন্ত ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ৪ হাজার ৪৭৫ জন। চিকিৎসা নিয়ে ছাড়পত্র নিয়েছেন ৩ হাজার ৫৩৭ জন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে তারা ‘মহামারি’ না বললেও পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। আর যত রোগী হাসপাতালগুলোতে আসছেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকাভুক্ত হচ্ছেন, প্রকৃত সংখ্যা তার অনেক বেশি। কোনও কোনও হাসপাতালে রোগীদের অপেক্ষায় থাকতে বলা হয়েছে। কোথাও কোথাও বেড না থাকায় কর্তৃপক্ষ রোগীদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকায় রয়েছে ঢাকার ৩৬টি বেসরকারি হাসপাতাল আর সরকারি ১৩টি। কোনও কোনও হাসপাতালের নাম তালিকাতে থাকলেও সেখানে রোগীর সংখ্যা দেখানো হয়েছে শূন্য। অথচ সেসব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন।

তারা বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার তথ্যানুযায়ী,ঢাকায় বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে ১৯২টি। অথচ এর মাত্র ৮ ভাগ তথ্য দেয়। আর শহরের অলি-গলিতে রয়েছে অনেক ক্লিনিক ও হাসপাতাল, যেগুলোর তালিকাই নেই অধিদফতরে।