কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীর পশু হাটগুলো জমজমাট হয়ে উঠছে। পাঁচদিন আগে হাট বসা শুরু হলেও এই কয়দিন ক্রেতা শূন্যই ছিল। তাছাড়া দুইদিন বৃষ্টির কারণে পশু নিয়ে বিপাকেও পড়তে হয়েছে গরু ব্যবসায়ীদের। ক্রেতা না থাকায় অলস সময় কাটিয়েছেন তারা। তবে শুক্রবার ছুটির দিনেই বদলে গেছে পশুর হাটের চিত্র। কমবেশি প্রতিটি অস্থায়ী হাটেই বেড়েছে ক্রেতার সংখ্যা। অবশ্য ক্রেতাদের আনাগোনা বাড়লেও তেমন বিকিকিনি হতে দেখা যায়নি। হাটে আসা অনেকের অভিযোগ ব্যাপারীরা দাম ছাড়ছেন না।

পবিত্র কোরবানির ঈদের বাকি মাত্র একদিন। অথচ এ হিসেবে কোরবানির পশু বেচাকেনা কম। শনিবার (১০ আগস্ট) বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাবতলী পশুর হাটে ঢল নামে ক্রেতার। হাটে গরুও জমেছে পর্যাপ্ত। দর-কষাকষি চরমে। কিন্তু সেভাবে বেচাকেনা নেই।

ক্রেতা-বিক্রেতাদের সেই পুরানো অভিযোগ। ক্রেতারা বলছেন, দাম বেশি চাওয়া হচ্ছে গরুর। বিক্রেতারা বলছেন, গো-খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় পশুর দাম বেশি পড়ছে অন্যান্য বারের তুলনায়।

ফরিদপুর নগরকান্দা নাওডোবার ইমারত হোসেন ব্যাপারী। গত ০৪ আগস্ট (রোববার) হাটে ১২টি গরু তুলেছিলেন। প্রতিটি গরুর দাম এক থেকে চার লাখ টাকার মধ্যে। অথচ এখনও একটি গরুও বিক্রি করতে পারেননি ইমারত।

ইমারত বলেন, ভাই মন খারাপ। একটি গরুও বেচতে পারিনি। কিছুই বুঝতে পারছি না। মানুষের হাতে টাকা নেই, না-কি কোরবানি দেশে কম হচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারি না।হাটের অনেক ব্যাপারী মনে করছেন, গত দুই কোরবানির ঈদে শেষ সময়ে কম দামে গরু কিনেছেন ক্রেতারা। এই আশায় তারা গরু কিনছেন না আগে।

ফরিদপুর সদরের বাবু ব্যাপারী। হাটে ২৪টি গরু তুলেছেন। অথচ বিক্রি করেছেন মাত্র চারটি।

বাবু ব্যাপারী বলেন, ক্রেতারা বাজারে শুধু দর-কষাকষি করছেন। কেনেন না। ৩০০ টাকা কেজি দরে মাংস খাওয়ার আশায় আছেন হয়তো। তবে ব্যাপারীদের দাবি উড়িয়ে দিচ্ছেন ক্রেতারা। ক্রেতাদের দাবি অধিক লাভের আশায় গরুর দাম আকাশচুম্বী চাওয়া হচ্ছে।

শনিবার সকাল থেকে হাটে ঘুরছেন মিরপুর-১২ নম্বরের ক্রেতা মাসুম পারভেজ। তিনি বলেন, ব্যাপারী গরু ছাড়েন না। তারা বেশি দাম চেয়ে গরুর রশি ধরে রাখছে। ৮০ হাজার টাকার গরুর দাম বলে এক লাখ ২০ হাজার।

অন্যদিকে ব্যাপারীদেরও দাবি, প্রত্যাশিত দাম না পাওয়ায় গরু বিক্রি করছেন না। তবে তারা বলছেন, দুদিন হাতে রয়েছে, এই সময়টায় পশুর হাট আরো জমে উঠবে। গতকাল রাজধানীর ভাটারা হাটে গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকেই ক্রেতারা ভিড় করছেন পশুর হাটে। কেউ গরু দেখছেন আবার কেউ খাসির ব্যাপারীদের চারপাশে ঘোরা ফেরা করছেন।

এদের কয়েকজনকে দেখা যায়, দর কষাকষিও করছে। সিরাজগঞ্জ থেকে সুবজ উদ্দিন এসেছেন ১২টি গরু নিয়ে। এর মধ্যে একটি মাত্র গরুবিক্রি করতে পেরেছেন গত পাঁচদিনে। সবুজের আনা গরুগুলো প্রতিটিই মাঝারি ধরনের। গড়ে ৯০ থেকে ১ লাখ টাকার মধ্যে বিক্রি করবেন বলে জানান এই ব্যাপারী। তিনি বলেন, গত এক বছর ধরে গরুগুলোর যতœ করছি। ৯০ হাজার টাকা করে বিক্রি করবো ভাবছি। কিন্তু সবাই দামাদামি করে যাচ্ছে। কিনছে না। আমিও এখনও আশায় আছি। দুইটা দিন তো আছে। নীলফামারী থেকে সুজন এসেছেন ৪টি গরু নিয়ে। বড় আকৃতির এই গরুগুলো দেড় লাখ টাকা মূল্য হাঁকাচ্ছেন তিনি। সুজন বলেন, একেকটা গরু পেছনে আমার ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা খরচ গেছে। দেড় লাখ টাকা চাইছি তো বেশি না। সবাই বলছে দাম বেশি। ব্যাপারীরা দাম ছাড়ছেন না বলে ক্রেতারাও তাই দিয়ে আসছেন এমন নয়। যাদের বাসা ভাটারা কিংবা বাড্ডা এলাকায় তারা আপাতত দেখার মাঝেই আছেন। ঈদের আরো দুদিন সময় থাকায় এখনই বেশি দাম দিয়ে কিনতে নারাজ ক্রেতারা। ফয়সাল হাসান নামের এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, এই কয়দিন তো হাটে আসার সুযোগ পাইনি। শুক্রবার টার্গেট ছিল। তাই এলাম। কিন্তু ব্যাপারীরা দাম ছাড়ছেন না। কিনবো কীভাবে! অবশ্য এখনই বেশি দাম দিয়ে হুট করে একটা কিনে বোকামি করতে চাই না। দেখি দাম কমলে হয়তো কাল কেনা যাবে। উত্তর বাড্ডার ব্যবসায়ী হাসানুজ্জামান বলেন, অন্য বছরের চেয়েও এবার দাম অনেক। গরু কিনতে আসলাম আজই। গত দুদিন বাসা থেকে তো বের হতে পারলাম না। কিন্তু ব্যাপারীরা যে গরু ৯০ হাজার টাকা সেটা দেড় লাখের বেশি চেয়ে বসে আছে। কমাতে বললে ৫ হাজার কমানোর কথা বলে চুপ করে থাকে।

এদিকে একই হাটের আরো কয়েকজন ব্যাপারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় প্রত্যাশা অনুযায়ী ক্রেতা পাচ্ছে না না তারা। টাঙ্গাইল থেকে দুটি গরু নিয়ে হাটে এসেছেন আবু তাহের। তিনি বলেন, তিন দিন হলো হাটে এসেছি। কিন্তু ক্রেতা পাচ্ছি না। গরু দুটির মধ্যে একটি ১ লাখ ও অন্যটি ৯০ হাজার টাকা পেলেই বিক্রি করবেন বলে জানান তিনি। ফরিদপুর থেকে ১৬টি গরু নিয়ে এসেছেন সবুর মিয়া। তিনি বলেন, চার দিন আগে এসেছি। এখন পর্যন্ত মাত্র তিনটি গরু বিক্রি করেছি। নাটোর থেকে আসা মাহিদুল ইসলাম জানান, তিনি তার এলাকা থেকে ৩০টি গরু কিনে এনেছেন বিক্রি করার জন্য। একটি গরুও বিক্রি করতে পারেননি। তবে আশা করছেন, এই দুদিনে গরুগুলো বিক্রি করতে পারবেন।

এদিকে শনিবার দুুপুরের পর রাজধানীর আরেক পশুর হাট আফতাবনগরেও দেখা যায় ক্রেতাদের ভিড়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ব্যাপারীরা সারিবদ্ধভাবে গরু ছাগল দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। ক্রেতাদেরও ভিড় দেখা গেছে। তবে দরকষাকষি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এই হাটে কয়েকজনকে অবশ্য গরু নিয়ে স্বস্তিতে বাড়ি ফিরতে দেখা গেছে। হাসান নামের একজন জানান, অনেক দরকষাকষির পর গরু কিনতে পেরেছেন। দাম ছাড়ছিল না। শেষ পর্যন্ত বড় আকৃতির লাল রঙের একটি গরু ১ লাখ ৬২ হাজার টাকায় কেনা হলো তার। হাসান বলেন, এত বড় হাট। এত গরু এসেছে। কিন্তু বেপারীরা নিজের সিন্ধান্ত নিয়ে বসে থাকেন। এক লাখ আশি হাজার বলেছে সেখানেই শেষ। এর নিচে নামবে না।

এভাবে চার ঘন্টা ঘুরে একটা গরু কিনেছি। সৌরভ তার বাবাকে নিয়ে হাটে এসেছেন। আফতাব নগরেই বাসা। তিনি জানান, গরুর দাম অনেক। তবে বাসার এলাকায় যেহেতু হাট আছে। চিন্তা নেই বাকি দুদিনেও কেনা যাবে। সৌরভ আরো জানান, দুই ঘন্টায় পঁচিশটির মতো গরু দেখেছেন। কিন্তু কোনোটির দাম তার বাজেটের সঙ্গে মেলে না। এই হাটে ঝিনাইদহ থেকে ৭টি গরু নিয়ে এসেছেন আরিফ নামের এক বেপারী। তিনি বলেন, গত বছরও লস গেছে। যে টার্গেট নিয়ে আসি সেটা হয় না। গরু বেচা হয় না। আশি হাজার টাকা খরচ করে যদি ২০ হাজার টাকা লাভ না পাই তাইলে হবে কিভাবে? এবারও মনে হয় লস নিয়া বাড়ি যাবো। অবস্থা খুব খারাপ। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের পশুর হাটের চিত্র গত দুইদিনের চেয়ে গতকাল বেশ বদলে গেছে। সরজমিন, গাবতলী, কমলাপুর স্টেডিয়াম সংলগ্ন হাটগুলোতে ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।