রাজধানীর মিরপুর ৭ নম্বরে রূপনগর থানার পেছনে চলন্তিকার মোড় সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তিতে পোড়া ধ্বংসস্তুপে নিজেদের অবশিষ্ট জিনিসপত্র খুঁজছেন ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসী। তবে কিছুই পাচ্ছেন না তারা। বেশিরভাগ ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারেনি বাসিন্দারা। ঈদের কারণে বেশিরভাগ বস্তিবাসীই গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। আগুনের খবর পেয়ে অনেকেই শনিবার ভোর থেকে নিজ আবাসস্থলে ফিরে ঘর খুঁজছেন।

আগুনের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। কমিটির প্রধান করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (অ্যাম্বুলেন্স) আবুল হোসেনকে। অপর দুই সদস্য হলেন সহকারী পরিচালক (অপারেশন্স) আব্দুল হালিম ও উপ-সহকারী পরিচালক (ঢাকা জোন-২) নিয়াজ আহমেদ। আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, পুরো বস্তিতেই প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছিল। আগুন লাগার পর পাইপ গলে গিয়ে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে। আগুনে বস্তির তিন হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুনে চারজন আহত হলেও প্রাণহানির কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ঈদের ছুটিতে অধিকাংশই গ্রামের বাড়িতে থাকায় বস্তি অনেকটাই লোকশূন্য ছিল।

শনিবার সকালে চলন্তিকা মোড়ে সংবাদ সম্মেলনে ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘বস্তিতে আনুমানিক ৫ থেকে ৬শ’ ঘর ছিল। আমরা কিছু ঘর এবং পরিবারগুলোকে সেভ করতে সক্ষম হয়েছি। তবে আগুনে বস্তির তিন হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টিনের চালাঘর সব ধসে পড়েছে। যা সরিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমাদের বেগ পেতে হয়েছে। এছাড়া অনেক দাহ্য পদার্থও ছিল। গ্যাসের সংযোগগুলো ভার্নাবল অবস্থায় ছিল। ফলে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া সহজ দাহ্য বস্তু দিয়ে বস্তির ঘরগুলো তৈরি করা হয় এবং পাশাপাশি একত্রে লাগানো থাকে। কোনো সেপারেশন থাকে না। এজন্যই বস্তির আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।’

শনিবার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, আগুনের ভয়াবহ তীব্রতায় ঝিলপাড় বস্তি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। সাধ্যের মধ্যে সাজানো-গোছানো আশ্রয়স্থল হারিয়ে বাকরুদ্ধ বস্তিবাসী। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কাঁচা টিনের ঘরগুলো এবং ঘরের সব সরঞ্জাম। আর এই ধ্বংস্তুপে সব হারানো মানুষগুলো খুঁজে ফিরছেন অবশিষ্ট সম্বল। পোড়া ছাই নেড়ে-চেড়ে লোহার আসবাবের ফ্রেমগুলো বের করায় ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে কয়েকজন বস্তিবাসীকে।

ক্ষতিগ্রস্ত জাহানারা বেগম বলেন, ‘আমার ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আগুনের পর বেশিরভাগ বাসিন্দাই বের হয়ে আসতে পেরেছেন। ঈদের ছুটির কারণে বস্তিতে থাকা পোশাক শ্রমিকরা এখনো আসেননি। তাই বস্তির ভেতরে আটকা পড়ার সম্ভাবনা কম।’

আবুল হোসেন বলেন, ‘বস্তিতে আমার ৯টি ঘর রয়েছে। এগুলো ভাড়া দেই। একটি ঘরও রক্ষা পায়নি, সব পুড়ে ছাই। বস্তির উত্তর পাশে ফরিদের ঘর থেকে আগুন লেগেছে। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে। তবে আমি নিশ্চিত নই।’

তানিয়া বলেন, ‘এখানে আমার ১৫টি ঘর রয়েছে। সব পুড়ে গেছে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আমি বের হয়ে এসেছি। তবে জিনিসপত্র কিছু বের করতে পারিনি।’

সবজি বিক্রেতা হাফিজুর রহমান জানান, অসুস্থ মাকে নিয়ে হাসপাতালে ছিলেন তিনি। আগুনের খবর পেয়েই ছুটে আসেন আবাসস্থলে। কিন্তু ততোক্ষণে আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বস্তির ৪০ ঘরের মালিকানার দাবিদার ফরিদ জানান, আগুনে তার তিনটি ঘর ছাড়া বাকি সবগুলোই পুড়ে গেছে। প্রায় ১০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। তিনি আরো বলেন, বস্তির অধিকাংশ পরিবারেই ফ্রিজ-টিভি ছিল। এছাড়া অন্যান্য দামী আসবাবপত্রও ছিল। যে কারণে ক্ষক্ষতির পরিমাণ বেশি হবে।

বস্তির বাসিন্দা চা দোকানি এনায়েত জানান, বস্তিতে দুই থেকে তিন হাজার অবৈধ গ্যাস সংযোগ ছিল। একটি সংযোগে ৩০ থেকে ৪০টি চুলা জ্বলতো। অধিকাংশ সংযোগই ছিল প্লাস্টিক পাইপের। বস্তিতে রুম ভেদে ভাড়া ছিল তিন থেকে চার হাজার টাকা করে। প্রতিটি চুলায় গ্যাস সংযোগের জন্য মালিক নিতেন ৬০০ টাকা করে। তবে পানির জন্য কোনো টাকা বস্তিবাসীদের দেয়া লাগতো না।

ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, বস্তির পুরো এলাকায়ই প্লাস্টিকের গ্যাসলাইন ছিল। যেকোনোভাবে আগুন লাগার পর প্লাস্টিকের গ্যাসলাইনগুলো গলে যায়। যে কারণে আগুন দ্রুত ছড়ায়।

আগুন নেভাতে প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রধান সমস্যা বস্তির এন্ট্রি পয়েন্ট একটা এবং সরু গলির কারণে বস্তি পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌঁছানো যায়নি। যার ফলে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। ঘরগুলো কাঁচা এবং ঘরগুলোর মধ্যে কোনো সেপারেশন ছিল না। আগুনে কাঠ আর বাঁশে তৈরি মাচাঘর ভেঙে পড়ে ঝিলে। ভেতরে ঢুকতে ঝিলে নামতে হয়েছিল ফায়ারকর্মীদের।