রাজবাড়ির পাশদিয়ে প্রায়ই হাঁটাহাঁটি করি কিছু পাবার আশায় নয়। শুধু কারণ একটাই বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তা পার হলেই ব্রুন্সভিকেন (Brunnnsviken) যাকে আমি বলি বে অফ বাল্টিক সাগর। স্টকহোম শহর গড়ে উঠেছে ম্যালার লেক এবং বাল্টিক সাগরের সমন্বয়ে। তারপর বাংলাদেশের মানুষের উদ্দেশ্যে যেহেতু কিছু বলি তাই ব্রুন্সভিকেন না বলে সচারাচর বাল্টিক সাগরে বলে থাকি। অনেকে কমেন্টস করেছে দেখতে বড় পুকুর বা নবগঙ্গা নদীর মত অথচ তা কি করে বাল্টিক সাগর হয়। যাইহোক সেই বাল্টিক সাগরের পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কোন এক সময় ক্রাউন প্রিন্সেস ভিক্টোরিয়ার বাডির পাশে হাজির হই। কারণ তাঁর বাড়ির তিন পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে এই ব্রুন্সভিকেন।

চমৎকার হাঁটার পথ সাথে সাগরের ঢেউ, মাঝেমধ্যে একঝাঁক বুনোহাসের আগমন, ছোট ছোট স্পিডবোট, উঠন্ত এবং পড়ন্ত সূর্যের উদয় বা অস্ত যাওয়া, সাথে বাল্টিক সাগরের দুই ধারের নানা রকম গাছপালা, বাড়িঘর সব মিলে পরিবেশটা মনোমুগ্ধকর। এমন মন মাতানো দৃশ্য উপভোগ করার সৌভাগ্য জীবনে যখন হয়েছে তাই তাকে বার বার দেখি এবং অনুভব করি হৃদয়, মন, প্রাণ দিয়ে।

হাঁটতে পথে ভাবনার জগতে নানা চিন্তার আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু সব চিন্তার সমাধান পাওয়া যায় না। তার পরেও সে চিন্তা সাগরের পানির মত বয়ে চলেছে। আজ সেই চিন্তার একটি অংশ নিয়ে মনের সাগর পাড়ি দিব। বিবেকের দুয়ারে প্রশ্ন এসেছে জন্মের শুরুতেই কি ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছে? নাকি এর পরিবর্তন করা সম্ভব জীবন চলার পথে? ভেবেছি অনেক, উত্তর খুঁজে পেয়েছি কিনা তা বলতে পারব না তবে তুলে ধরব কিছু রিফ্লেকশন।

সুইডেনের রাজার জন্ম রাজপরিবারে। বাবার অবর্তমানে তিনি দেশের নিয়ম অনুযায়ী রাজা হয়েছেন। তিনি বিয়ে করেছেন রাজপরিবার এবং দেশের বাইরে। তাঁদের পরিবারের বড় সন্তান ভিক্টোরিয়া। সুইডেনের নিয়ম অনুযায়ী পরিবারের বড় সন্তান ভিক্টোরিয়া হবেন পরবর্তি রানী। তাই তাঁকে সেই ভাবে তৈরি করা হয়েছে। ভিক্টোরিয়াও বাবার মত রাজপরিবারের বাইরে এবং অত্যন্ত সাধারণ পরিবারের একটি ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। তাঁদের প্রথম সন্তান মেয়ে, নাম এস্টেলা। এস্টেলাও রাজ পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী জন্ম সূত্রে পরবর্তি রানী হবে।

আমার জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত সাধারণ পরিবারের গ্রামের বাড়িতে। দাদা এবং নানা কৃষক পরিবারের সন্তান, বাবা কৃষিকাজকে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে দেশসেবায় সরকারী চাকুরী নিয়ে জনগণের সেবাই নিয়োজিত হয়েছিলেন। জন্ম সূত্রে তিনি কৃষক না হয়ে চাকুরী পেশা বেছে নিয়েছিলেন। বাবার ভাগ্য জন্ম সূত্রে নির্ধারিত হয়নি। এখন প্রশ্ন যদি আমার বাবার পর্যাপ্ত পরিমান জমিদারি থাকত তাহলে কি তিনি কৃষিকাজ ছেড়ে চাকুরী পেশা বেছে নিতেন?

আমার জন্ম কৃষি এবং চাকুরীর মিশ্রণে। হঠাৎ দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছি বহু বছর আগে। নতুন করে জন্ম অন্যজগতে, তাও জন্মের প্রায় বিশ বছর পরে। জ্ঞানের ভান্ডারে যা জমা হয়েছিল তার কিছু অংশ কাজে লাগিয়ে বাকি সব নতুন করে শিখতে হয়েছে। নতুন শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নতুন সমাজে এডজাস্ট এবং ম্যানেজ করে চলতে হয়েছে। লেখাপড়া শেষে চাকরী,পরে বিয়ে করেছি যাকে তাঁর বাবার জন্মস্থান স্পেনে এবং তিনিও তার জীবনের ৩০% সময় কাটিয়েছেন স্পেনে।

আমাদের ছেলের জন্ম হয়েছে সুইডেনে। ছেলের বাবার জীবনের ৩০% সময় কেটেছে বাংলাদেশে। ছেলের মা সুইডিশ। তবে ছেলের মা তাঁর বাবার কারনে ২০% সময় কাটিয়েছেন স্পেনে। এ ক্ষেত্রে ছেলে সুইডিশ পরিবেশে জন্ম হলেও বেশ কিছুটা মিশ্র কালচারে প্রভাবিত। যাইহোক ছেলে তার কর্মে বেছে নিয়েছে স্পোর্টস যা আমার বা আমার স্ত্রীর পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত নয়।
আমার উপরের বর্ণনায় একটি জিনিষ লক্ষনীয় তা হলো আমাদের জন্মের শুরুতে সবার স্টার্টিং পয়েন্ট এক নয়, প্রচুর তফাৎ। যেমন সব নদীর সৃষ্টি বা উৎপত্তি হিমালয় থেকে হয়নি। আবার অনেক নদী হিমালয় থেকে উৎপত্তি হয়েছে। মানব জীবনে সবার জন্মও রাজপরিবারে হয়নি।
আমার ভাবনায় ঢুকেছে প্রশ্ন:- তাহলে কি জন্মের শুরুতেই ভাগ্য নির্ধারিত, নাকি জন্মের পর কর্মের ফলের উপর নির্ভর করছে ভাগ্য?

যাই হোক না কেন তবে একটি বিষয় পরিষ্কার তা হলো, রাজ বা সাধারণ পরিবারে জন্ম, এটা কারো চয়েস (choice) নয়। তবে জন্মের পরে দেখা যাচ্ছে কর্মের ধরণ, সুযোগ-সুবিধা খুঁজে বের করা এবং বিশাল ভাবে জীবনের পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন করা আমাদের চয়েস।

নদীর উৎপত্তি যে ভাবেই হোক না কেন তারা বয়ে চলেছে সাগরের উদ্দেশ্যে। তেমনি মানব জাতির জন্মে বিশাল পার্থক্য সত্বেও সংগ্রাম করে চলছে জীবন গড়ার স্বপ্নে যা ভাবতেও ভালো লাগছে এই ভেবে যে পরম করুণাময় আমাদের স্রোতের মত গতি দিয়েছেন জীবন চলার পথে। যে গতিতে রয়েছে ভালোবাসা, রয়েছে আশা আর ভরসা। আমি পারব, আমি করব, আমি জয়ী হব – কারণ আমার নাম মানুষ।

রহমান মৃধা, দূরপরবাস সুইডেন।