গাজীপুরে শ্রীপুরের জৈনাবাজারে গুলি করে ও ককটেল ফাটিয়ে দু’টি জুয়েলারী দোকানে ফিল্মি স্টাইলে সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনায় জড়িত এক দম্পতিসহ আন্তঃজেলা দুধর্ষ ডাকাতদলের ১০জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ধামরাই ও আশুলিয়া এলাকার দু’জন স্বর্ণ ব্যবসায়ীও রয়েছে। তাদের কাছ থেকে লুন্ঠিত স্বর্ণালকার ও নগদ টাকাসহ ককটেল, চাপাতি ও মোটরসাইকেল এবং ডাকাতি কাজে ব্যবহৃত মালামাল জব্দ করা হয়েছে। এ ডাকাতদলটি ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়নগঞ্জসহ রাজধানীর আশেপাশের জেলায় বিভিন্ন জুয়েলারী, মোবাইল ও বিকাশের দোকানে ইতোপূর্বে ডাকাতি করেছে। তারা নারায়নগঞ্জ ও গাজীপুরের দু’টি দোকানে চলতি সপ্তাহে ডাকাতির পরিকল্পনা করেছিল। এজন্য তারা প্রাথমিক প্রস্তুতির কাজও ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছে। পুলিশের অভিযানে তাদের সে পরিকল্পনা পন্ড হয়েছে। রবিবার দুপুরে গাজীপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

গ্রেফতারকৃতরা হলো- পাবনার সুজানগর থানার রায়পুর ক্ষেতুপাড়া এলাকার মৃত খবির উদ্দিনের ছেলে ডাকাত সর্দার মনির মোল্যা ওরফে মনির ওরফে মনি মোল্লা ওরফে আকুব্বর হোসেন আকু (৩৮), মনিরের স্ত্রী মোসাম্মৎ ছুম্মা খাতুন (৩২), একই জেলার সদর থানার শালাইপুর কামরীপাড়া এলাকার ইছহাক প্রামাণিকের ছেলে ডাকাতদলের সেকেন্ড ইন কমান্ড আলমগীর হোসেন ওরফে আলম (৪০), মাদারীপুরের শিবচর থানার চর চান্ডা এলাকার মৃত ইউনুছ সরদারের ছেলে সাইদুর সরদার (৪৪), রাজবাড়ির পাংশা থানার রূপীয়াট এলাকার লিয়াকত আলী শেখের ছেলে রানু শেখ ওরফে নান্নু শেখ (৩৮), বগুড়ার গাবতলী থানার মাঝবাড়ী পশ্চিমপাড়া এলাকার মৃত নঈম প্রামাণিকের ছেলে বাদশা প্রামাণিক ওরফে বাবু ওরফে বাদশা বাবু (৩৮), শরীয়তপুরের ডামুড্ডা থানার বড় সীধুলকুড়া এলাকার আব্দুল মতিনের ছেলে নাজমুল (২৬), নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার বানিয়াদী এলাকার আব্দুল মেতালিবের ছেলে সুজন (২৪), ঢাকার আশুলিয়া থানার বারইপাড়া এলাকার মৃত চিত্ত রঞ্জন সরকারের ছেলে স্বর্ণ ব্যবসায়ী সঞ্জয় সরকার (৪০) এবং একই জেলার ধামরাই থানার নোয়ানগর এলাকার ভবতোষ পালের ছেলে স্বর্ণ ব্যবসায়ী বিবেক পাল (৪২)। গ্রেফতারকৃতরা সবার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় একাধিক ডাকাতির মামলা রয়েছে।

পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার জানান, গত ১৫ নবেম্বর সন্ধ্যায় গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার জৈনাবাজার এলাকার লক্ষ্মী জুয়েলার্স ও পাশর্^বর্তী নিউ দিপা জুয়েলার্স নামের দু’টি স্বর্ণের দোকানে গুলি করে ও ককটেল ফাটিয়ে একযোগে ডাকাতি করে সশস্ত্র একটি ডাকাত দল। ডাকাতরা ২মিনিট ৪৩ সেকেন্ড স্থায়ী ডাকাতিকালে ওই দু’দোকান থেকে ৮০ ভরি স্বর্ণ, ৫০০ভরি রূপা ও নগদ ৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা লুট করে নিয়ে যায়। ডাকাতদল এক দোকানের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার হার্ডডিস্কও খুলে নিয়ে যায়। এসময় বাঁধা দেওয়ায় ডাকাতদের ছোঁড়া গুলিতে দিপা জুয়েলার্সের মালিক দেবেন্দ্র কর্মকার গুরুতর আহত হন। এ ঘটনার পর পরই জেলা গোয়েন্দা পুলিশ ও থানা পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত টিম তদন্ত শুরু করে অভিযানে নামে। এ টিমের নেতৃত্ব দেন গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ জানান, ঘটনার পর পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গাজীপুরের জয়দেবপুর থানার হোতাপাড়া এলাকার এ্যালিগেন্স গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীর পাশর্^বর্তী একটি বাসা থেকে ডাকাতদলের সেকেন্ড ইন কমান্ড আলমগীর হোসেন ওরফে আলমকে আটক করে। এসময় তার ভাড়া বাসা থেকে ককটেল ও চাপাতিসহ ডাকাতি কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সিরাজগঞ্জ, পাবনা, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, নারায়নগঞ্জ, ঢাকা ও গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ডাকাতদলের ওই ১০জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে লুন্ঠিত ৪৩ভরি স্বর্ণালংকার, ২কেজি ৬০০গ্রাম রূপা, এক লাখ ৫৬হাজার ৩২০টাকা, ৭টি ককটেল, একটি চাপাতি ও একটি মোটর সাইকেল জব্দ করা হয়। এ ডাকাত দলের সদস্যদের গ্রেফতারের ফলে ঢাকা ও আশেপাশের জেলাগুলোতে ডাকাতি প্রবনতা হ্রাস পাবে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান, গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানার মৌচাকের ভান্নারা এলাকায় স্ত্রী ও দু’সন্তানকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতো ডাকাত সর্দার মনির। দুধর্ষ মনির ঝুট ব্যবসার আড়ালে ডাকাতি করতো। শ্রীপুরের এ ডাকাতির পূর্বে মনিরের স্ত্রী ছুম্মা খাতুন ও অপর দু’জন ঘটনাস্থল রেকি করে। পরে ঘটনার দিন সকালে নারায়নগঞ্জ ও কালিয়াকৈর হতে ডাকাত দলের সদস্যরা গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ভোগড়া এলাকায় এসে মিলিত হয়। পরে তারা মাইক্রোবাস ও মোটর সাইকেলে চড়ে জৈনা বাজারে এসে এ ডাকাতি করে। তারা স্বর্ণালকারসহ লুন্ঠিত মালামাল হোতাপাড়া এলাকায় ডাকাতদলের সেকেন্ড ইন কমান্ড আলমগীর হোসেনের বাসায় জমা রেখে পালিয়ে যায়। পরদিন ডাকাতির লুন্ঠিত স্বর্ণ ও রূপার অলংকার স্বর্ণ ব্যবসায়ী সঞ্জয় সরকার ও বিবেক পালের কাছে ১৮ লাখ টাকায় বিক্রি করে। এ টাকা থেকে পৌণে দু’লাখ টাকা অস্ত্র কেনার জন্য জমা রাখে। অবশিষ্ট টাকা তারা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। এ ডাকাতি করার জন্য গ্রেফতারকৃত স্বর্ণ ব্যবসায়ী সঞ্জয় সরকার ও বিবেক পাল ডাকাত দলকে তিন লক্ষাধিক টাকা অগ্রীম প্রদান করে বলে গ্রেফতারকৃতরা পুলিশকে জানিয়েছে।

তিনি আরো জানান, ডাকাতদলটি গাজীপুরের কোনাবাড়ির বিকাশ এজেন্টের একটি অফিসে এবং নারায়নগঞ্জের একটি জুয়েলারী দোকানে চলতি সপ্তাহে ডাকাতি করার পরিকল্পনা করেছিল। এজন্য রেকিসহ ডাকাতির প্রাথমিক কাজ ইতোমধ্যে তারা সম্পন্ন করেছে। এ দু’ডাকাতির জন্য আরো অস্ত্র কেনার জন্য পৌণে দু’লাখ টাকা পাবনার এক অস্ত্র ব্যবসায়ীকে দেয়। তারা ওই অস্ত্র হাতে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। অস্ত্র হাতে পেলে ওই দু’জেলার জুয়েলারী ও বিকাশ এজেন্টের দোকানে ডাকাতি করতো বলে গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে।

তিনি জানান, শ্রীপুরের জৈনাবাজারে ডাকাতির ঘটনার পর পরই পুলিশ তদন্ত শুরু করে অভিযানে নামে। তারা ডাকাতির ঘটনার সময়ে ধারণকৃত এক দোকানের সিসি টিভির ফুটেজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। এছাড়াও া ফার্মগেইট, মানিকগঞ্জ, আশুলিয়া ও মাওনসহ ঢাকা ও আশেপাশের এলাকায় বিভিন্ন সময়ে স্বর্ণের দোকানে সংগঠিত ডাকাতির ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে পুলিশের একাধিক টিম বিভিন্ন জেলায় একযোগে অভিযান চালিয়ে ওই ১০জনকে গ্রেফতার ও লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধার করে। অবশিষ্ট মালামাল ও ডাকাত দলের অপর সদস্যদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশের অভিযান অব্যহত রয়েছে।