প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন, আইনজীবীগণ বিচার ব্যবস্থার একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। আইনজীবীগণ হচ্ছেন সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ার, আর বিচারকরা হচ্ছেন বিচারের মূর্ত প্রতীক। আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিচারক ও আইনজীবীদেরকে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রনী ভ’মিকা পালন করতে হবে। আইনজীবীগণ বিচার ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। আইনজীবীদের সহায়তা ছাড়া বিচার ব্যবস্থা কিছুতেই অগ্রসর হতে পারে না।

তিনি বলেন, যারা বাংলাদেশের অস্তিত্ত্বকে বিশ^াস করে না সেই বিপথগামী গোষ্ঠী বার বার বিচার ব্যবস্থার উপর আঘাত করে। তারা বিচারক হত্যা করে, আইনজীবী হত্যা করে। তারা জানেনা ব্যক্তিকে হত্যা করা যায়, কিন্তু আদর্শকে হত্যা করা যায় না। বাংলাদেশের শান্তি শৃঙ্খলা বিঘিœত করতে এবং দেশকে অস্থিতিশীল করে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য তাদের এ অপপ্রয়াস। এ রাষ্ট্রদ্রোহী অপশক্তির তৎপরতা কোনভাবেই যেন বিচারাঙ্গনকে কুলষিত করতে না পারে সেজন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

রবিবার বিকেলে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ২০০৫সালে গাজীপুর আইনজীবি সমিতির কক্ষে জেএমবি’র আত্মঘাতি বোমা হামলার ১৪ বছর উপলক্ষে গাজীপুর জেলা আইনজীবী সমিতির কার্যালয় চত্বরে আলোচনাসভা ও দোয়া অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওইসব কথা বলেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর রাজনৈতিক অপশক্তির প্রভাব দেশে ধর্মান্ধ ও প্রতিক্রিয়াশীল বিভিন্ন চক্রের উদ্ভব ঘটে। নানা পৃষ্ঠপোষকতায় স্বাধীনতা বিরোধী ও জঙ্গীবাদে বিশ^াসী চক্রটি তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করতে থাকে। এ প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের মূল টার্গেট হলো বিচারাঙ্গন। দেশের বিচারঙ্গনের বিচারক ও আইনজীবীগণ বারবার এ ঘৃণিত চক্রের নির্মম ও মর্মাান্তিক হামলার শিকার হয়েছে। সমাজের শান্তি শৃঙ্খলা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচারক ও আইনজীবীগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এ অপশক্তিকে বিতাড়িত করে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ^াস।

তিনি আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি আশা করছি জ্ঞানের চর্চায় বর্তমান আইনজীবী সমাজ পূর্বের চেয়ে আরো এগিয়ে যাবেন এবং তাদের মেধা, প্রজ্ঞা, সততা ও আন্তরিকতা দ্বারা বিচার প্রার্থীদের দ্রুত ন্যায় বিচার প্রাপ্তিতে সহায়তা করবেন। আইনের শাসন, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রতি আইনজীবীদের রয়েছে অকুণ্ঠ বিশ^াস। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আপনাদেরকে নির্ভিক হতে হবে। নিরন্তর কর্মে নিমগ্ন থেকে নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করতে হতে হবে। শিক্ষা ও জনকল্যানমুখী কর্মকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সচেষ্ট হতে হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করি একজন গুণী আইনজীবী সমাজের একজন দরদী মানুষ বটে। আইনজীবীদের হতে হবে উন্নত চরিত্রের অধিকারী, দৃঢ় প্রত্যয়ী ও প্রজ্ঞাবান।

গাজীপুরের জেলা জজের বিচারক সংকটের বিষয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, গাজীপুর আদালতে এজলাশের সংকট না থাকলে এখানে আরও বিচারক প্রেরণ করা হবে, যাতে এখানে বিচার কাজ ত্বরান্বিত হয়।

গাজীপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. খালেদ হোসেনের সভাপতিত্বে ও সাধরণ সম্পাদক মঞ্জুর মোর্শেদ প্রিন্সের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক, গাজীপুরের জেলা ও দায়রা জজ এ কে এম আবুল কাশেম, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম, সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন খান, গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি আইনজীবী আজমত উল্লাহ খান, সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী এসএম সফিকুল ইসলাম, গাজীপুর জজ আদালতের আইনজীবী ওয়াজ উদ্দিন মিয়া, পিপি মো. হারিছ উদ্দিন আহমদ, আইনজী সুলতান উদ্দিন, জিপি মো. আমজাদ হোসেন বাবুল, আইনজীবী নুরুল আমিন, দেওয়ান আবুল কাশেম, জেবুন্নেছা মিনা প্রমূখ।

এর আগে রবিবার সকালে প্রথমে গাজীপুর জেলা আইনজীবী সমিতির কার্যালয়ের চত্বরে ওই সংগঠণের সভাপতি এডভোকেট মোঃ খালেদ হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোঃ মনজুর মোর্শেদ প্রিন্সসহ সমিতির নেতৃবৃন্দ জাতীয় পতাকা ও কালো পতাকা উত্তোলন করেন এবং তাদের সহকর্মীরা কালো ব্যাচ ধারণের মধ্য দিয়ে দিনের কর্মসূচির সূচনা করেন। এ উপলক্ষে একটি শোকর‌্যালী বের করা হয়। দুপুরে গাজীপুর জেলা আইনজীবী সমিতির প্রাঙ্গণে এক দোয়া ও খাবার বিতরণ করা হয়।

গাজীপুরের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ ড. এ কে এম আবুল কাশেম, গাজীপুর আদালতের বিচারকবৃন্দ এবং গাজীপুর জেলা আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দ নিহত আইনজীবীদের জন্য স্মৃতি স্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

প্রসঙ্গতঃ ২০০৫ সালের ২৯ নবেম্বর সকালে গাজীপুরের আইনজীবি সমিতির ২নং হলরুমে জেএমবি’র আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। আইনজীবিদের চিরাচরিত কালো পোশাক পরিহিত ছদ্মবেশী জেএমবি সদস্যের আত্মঘাতী হামলায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। এঘটনায় ৪ আইনজীবি মোঃ আমজাদ হোসেন, মোঃ আনোয়ারুল আজিম, মোঃ গোলাম ফারুক, মুহাম্মদ নুরুল হুদা ও ৫ বিচারপ্রার্থী ছাড়াও আত্মঘাতি জঙ্গি শরীয়ত উল্লাহ ওরফে আসাদুল ইসলাম। আহত হন অন্ততঃ ২৫ আইনজীবিসহ আরো অনেকে। এ ঘটনার একদিন পর ১ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রধান ফটকে আত্মঘাতি বোমা হামলায় ৯ আইনজীবী ছাড়াও বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ও পথচারি আহত হন। এ ঘটনায় গুরুতর আহতদের মধ্য থেকে এস এম জয়নাল আবেদীন ও এডভোকেট খন্দকার আল-মামুন মাখন পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

আইনজীবি কক্ষে বোমা হামলার ঘটনায় ওই সময় ১০টি মামলা হয়। ঘটনার ৮ বছর পর ২০১৩ সালের ২০ জুন অভিযুক্ত ১০ জেএমবি সদস্যের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন দ্রুত বিচার আদালত-৪।