চলনবিলে গ্রামবাংলার বিলাঞ্চলের চিরচেনা ঐতিহ্যবাহি বাউত উৎসবে মেতেছে সৌখিন মৎস্য শিকারীরা। চলনবিল অধ্যুষিত পাবনার চাটমোহর ও ভাঙ্গুড়া অংশ জুড়েই শতশত সৌখিন মৎস্য শিকারীরা মিলিত হয়েছে এই বাউত উৎসবে। স্থানীয়রা বলছেন, কয়েকশ’ একর জমি জুড়েই বিল রহুলের সীমানা। বর্ষার সময়ে পানিতে থৈথৈ অবস্থায় থাকে। বর্ষার পানি নেমে গেলেও কিছু পানি থেকে যায় নীচু জমির কারণে। আর ওই পানিতে জলকেলিতে মেতে থাকে দেশীয় প্রজাতির নানা মাছ। প্রতৌক বছরই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সৌখিন মৎস্য শিকারীরা নানা ভাবেই একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে ডিসেম্বরের ৩ তারিখে ছুঁটে আসেন মাছ শিকারে। কাকডাকা ভোরে দুরদুরান্ত থেকে ইঞ্জিন চালিত নছিমন, করিমন, ভুটভুটি, মোটর সাইকেল, বাইসাইকেল এমনকি পায়ে হেটে বিলপাড়ে উপস্থিত হন। সৌখিন মৎস্য শিকারীরা হাত পলো, পাউ পলো, নেট পলো ছাড়াও ডোরা জাল, খেয়া জাল, হাতখড়া, বাদাই জাল, ঘেরজালসহ নানা উপকরণ নিয়ে নেমে পড়েন বিল রুহুলে। দেশীয় প্রজাতির মাছে মধ্যে শৈইল, বোয়াল, গজার, রুই, কাতলা, চিতল, পুঁটি, খৈলসা, টেংড়া, পাবদা, শিংসহ নানা জাতের মাছ পাওয়া যায়।

চলনবিলের সোকাদর, লাউগিলা, রুহুল বিল, মাঠবিল, বাওনজানি, সেওলার বিল, খিল বিল, নাড়লগাড়ি, হাতিগাড়া, দিকশির বিল, ডেঙ্গার বিল, খালিশাগাড়িবিল, বড়াল নদী, গুমানি নদী, চিকনাই, রত্মাই, করতোয়া নদীসহ বিলগুলোতে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পলো দিয়ে মাছ ধরার মাধ্যইে এই বাউত উৎসব শুরু করা হয়। প্রতিবছরেই এই সময়ে বিলগুলোতে পলো দিয়ে উৎসব মুখর পরিবেশে মাছ ধরা হয় বলেই স্থানীয়রা একে নাম দিয়েছেন বাউত উৎসব। চলনবিল কেন্দ্রীক পাবনা সদরসহ চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, আটঘরিয়া, নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াঁশ এলাকার সহস্রাধিক মানুষ এই বাউত উৎসবে যোগ দেন।

নাটোর থেকে আসা সৌখিন মৎস্য শিকারী আবু বকর বলেন, মোবাইল ফোনে নানা জেলার বাউতদের সাথে যোগাযোগ রেখেই প্রতিবছর এই দিনে আমরা বিল রুহুলে মাছ শিকার করতে আসি। কপালে মাছ জুটুক আর না জুটুক এটা আমাদের একটা সখ বলতে পারেন। ঈশ্বরদী থেকে আসা ৫৫ বছরের ময়েজ উদ্দিন বলেন, পলো দিয়ে মাছ ধরাটা তার নেশা। শত ব্যস্ততার মাঝেও বছরের একটি দিন ব্যয় করি রুহুলের বিলে চলে আসি। তবে আগের মতো দেশীয় প্রজাতির মাছ নেই বলে দাবী ময়েজ উদ্দিনের। বড়াইগ্রামের আফসার আলীর অভিযোগ, আমাদের আসার আগের রাতেই স্থানীয়রা জাল ফেলে মাছ ধরে নিয়েছে। তাই এবারে এসে কোন মাছ পাইনি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার সৈয়দ আশরাফুজ্জামান বলেন, এই বিলে প্রতিবছরই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সৌখিন মৎস্য শিকারীরা মাছ ধরার নেশায় ছুটে আসেন। এদিন মাছ শিকারীদের এক উৎসবে পরিণত হয়। তিনি বলেন, এই বাউত উৎসবে জেনেছি কৃষক, জেলে, ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, চিকিৎসকসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় এই উৎসব।

চাটমোহর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ মাহাবুবুর রহমান জানান, বাইত উৎসব গ্রামবাংলার ঐতিহ্য। দেশের অন্যান্য এলাকায় এই উৎসব বিলুপ্তির পথে। তবে এ এলাকায় ঐতিহ্যটি এখনও টিকিয়ে আছে। তিনি বলেন, বড়বিল, ডেঙ্গারবিল, খলিশাগাড়ি বিল, রুহুল বিল, দিকশির বিলসহ অন্যান্য বিলে বাউতরা মাছ শিকার করছেন। তবে বাউত উৎসবের ফলে জীবও বৈচিত্র নষ্ট হচ্ছে। দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ শেওলা জাতীয় প্রাকৃতিক মৎস্য খাদ্য পানি উপকারী অনুজীব এতে করে নষ্ট হয়ে যায়। এ ব্যাপারে সর্তকতা দরকার বলে দাবী তার।