প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রতিবন্ধী বা অটিস্টিকরা যেন আমাদের মূলস্রোতের সঙ্গে মিলিয়ে থাকতে পারে, জনগোষ্ঠীর সঙ্গে থাকতে পারে, এটাই হচ্ছে সব থেকে বড় কথা। আমরা চাই দেশের উন্নয়ন। এই উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের গুরুত্ব দিয়ে থাকি। কারণ তারা যেন কোনোভাবে পিছনে পড়ে না থাকে। কারণ সবাই মানুষ, আমাদের সবাই একসঙ্গে চলবে।

বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) রাজধানীর মিরপুরে ২৮তম আন্তর্জাতিক ও ২১তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস এবং জাতীয় প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্স সুবর্ণ ভবন উদ্বোধন উপলক্ষে তিনি এসব কথা বলেন।

সুবর্ণ ভবনে প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষা, চিকিৎসা, পুনবার্সন, আবাসিক সুবিধা, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে প্রায় ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। উদ্বোধন ঘোষণা শেষে প্রধানমন্ত্রী প্রতিবন্ধী শিল্পীদের বিভিন্ন সাংস্কৃতি পরিবেশনা উপভোগ করেন।

প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার প্রতিবছর মর্যাদার সঙ্গে দিবসগুলি পালন করে উল্লেখ করে প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে তার সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব পারসন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটি’ (সিআরপিডি) চুক্তিতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে এবং জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন মূলনীতি লিভিং নো ওয়ান বিহাইন্ড অর্থাৎ কেউ পিছনে পড়ে থাকবে না। সকল নিয়েই করতে হবে। এই অনুযায়ী আমরা দেশের সকল প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এছাড়া ২০১৯-২০ মেয়াদে জাতিসংঘের হিউম্যানন্ডার্স কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাতেও কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।

নিউরো ডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম-এ বিষয়ে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি সায়মা ওয়াজেদ হোসেন অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশ ও বিদেশে সচেতনতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশে এ ব্যাপারে কোনো সচেতনতা ছিল না। আজকে আর সে অবস্থা নেই। এখন মানুষ যথেষ্ট সচেতন। অটিজম সবসময় আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমরা মানুষের কাছে এই কথাটাই বোঝাতে চাই, অটিজম বা প্রতিবন্ধীতা এটা কোনো অসুস্থতা না, কোনো রোগও না। একটা মানুষ হয়তো জন্মগ্রহণ করেছে, এটা এখন কি কারণে অটিজম হয়। সেটা এখন পর্যন্ত সেভাবে কিন্তু আবিষ্কার হয়নি বা গবেষণা চলছে।

আবার প্রতিবন্ধিতা অনেক সময় জন্মগত হয় অনেক হয় অ্যাক্সিডেন্টে হয় পাশাপাশি নানা কারণে অসুস্থতা হয়। অনেক কারণে হয়। আগে পোলিও হলে অনেকে প্রতিবন্ধী হত। আজকে বাংলাদেশ পোলিও মুক্ত। আমরা যেহেতু পোলিও ভ্যাকসিন দিচ্ছি যার ফলে আমরা সেটা করতে সক্ষম হয়েছি। সেভাবে আমরা চেষ্টা করি।

আমাদের যারা এই ধরনের প্রতিবন্ধিতায় ভুগছে বা অটিজমে ভুগছে তাদেরকেও ট্রেনিং দিয়ে, সুস্থতা দিয়ে, তারা যেন আমাদের মূল স্রোতের সঙ্গে মিলিয়ে থাকতে পারে, জনগোষ্ঠীর সাথে থাকতে পারে এবং যে বাবা-মায়ের এই ধরনের প্রতিবন্ধী সন্তান হয় বা অটিস্টিক বাচ্চা হয়, তাদের জন্য এটা একটা বিরাট কষ্টকর বিষয়, সেটা আমরা জানি বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী এ লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে বলেন, তবে সব থেকে যেটা প্রয়োজন আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে। আমরা ছোটবেলা থেকেই পড়েছি, কানাকে কানা বলিও না, খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না। এই শিক্ষাটা একেবারে ছোটবেলা থেকেই আমাদের স্কুলের যারা ছোট বাচ্চা তাদেরকে দিতে হবে।জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ফাউন্ডেশনটা থাকলে সুবিধা হল, এখানে সামাজিক ক্ষেত্রে অনেকে বিভিন্ন অনুদান দেয়। অনেকে অবদান রাখে। আন্তর্জাতিকভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা এই ফাউন্ডেশনকে সহযোগিতা করে। শুধু আর্থিক সহযোগিতা না, সারাবিশ্বে এখন নানা ধরনের চিকিৎসা, অথবা ট্রেনিং অর্থাৎ একজন প্রতিবন্ধী যেন নিজে চলতে পারে, তাকে একটা বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হয়। এটা পৃথিবীর অনেক দেশে চালু আছে। এই ধরনের ট্রেনিং দেওয়ার সুযোগ এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আনা যায়।

ফাউন্ডেশনকে প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে আরও বেশি উদ্যোগ গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সারা বিশ্বে এরকম একলা চলার মতো একজন প্রতিবন্ধীকে প্রশিক্ষিত করা এবং তাকে সেভাবে ট্রেইনিং দেওয়া হয়। সেই ট্রেনিংগুলি আমরা যদি দিয়ে দিতে পারি, তাহলে তাকে আর পরনির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয় না। নিজেই সে চলতে পারে। কাজ করতে পারে। সেই ধরনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। আবার এর জন্য যে অর্থ সম্পদের প্রয়োজন হয়, সেটাও ফাউন্ডেশন থাকলে এই অর্থ আসা সহজ হয়ে যায়।

স্বাধীনতার পর জাতির পিতা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে অনেক জায়গা দিয়ে গেছেন। যে জায়গাগুলিতে আরও বেশি প্রতিষ্ঠান আমরা গড়তে পারি। তাই কোনো কোনো জেলা-উপজেলায় জমি আছে। কারণ বহু জমি হয়তো পতিত পড়ে আছে, বহু জমি দখল হয়ে গেছে, বহু জমি অব্যহৃত আছে, সেগুলো খুঁজে বের করতে মন্ত্রণালয়ের প্রতি অনুরোধ জানান এবং এসব জায়গায় উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে প্রজেক্ট নেওয়ার আহ্বান জানান।

ইতোমধ্যে ৬৪ জেলার ৩৯টি উপজেলায় মোট ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা সাহায্য কেন্দ্র চালু হয়েছে, সেটা আমরা প্রতিটি উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত করা হবে বলেও জানান তিনি।প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে অধিদফতর করার দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ফাউন্ডেশনকে আমি যদি অধিদপ্তর করি, সেখানে কিন্তু প্রতিবন্ধীদের খুব বেশি একটা সুবিধা হবে না। সুবিধা হবে সরকারি অফিসারদের। তারা আরেকটু প্রমোশনের জায়গা পাবে। কিছু পদায়নের জায়গা পাবে। কিন্তু ফাউন্ডেশন যদি থাকে তাহলে কিন্তু সেখানে আর্থিক অনুদান আসবে। বিদেশ থেকে ট্রেইনার নিয়ে এসে আমাদের দেশে আমরা মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করতে পারবো।

ফাউন্ডেশন থাকার বিভিন্ন রকম সুবিধা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, কাজেই ফাউন্ডেশনকে অধিদফতর করলে সরকারি অফিসারদের লাভ হবে কিন্তু প্রতিবন্ধীদের কতটুকু লাভ হবে, সেটা আমি বলতে পারব না। কারণ তাদের হাতে জিম্মি হয়ে যেতে হবে।

তিনি আরও বলেন, আমি জানি, আমাদের সরকারি কর্মচারীদের পক্ষ থেকে, এটা ভালো করে উৎসাহিত করা হয় যে, ফাউন্ডেশনকে অধিদফতর করা হোক। আসলে ফাউন্ডেশনকে অধিদপ্তর করা ঠিক না।