চীনা নাগরিক গাউজিয়ান হুই (৪৩) হত্যার পর আট দিন পর হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের কথা জানিয়েছে পুলিশ। এ ঘটনায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা (উত্তর) বিভাগের একটি টিম বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে ২ জনকে গ্রেফতার করে। তাদের জবানবন্দি থেকেই হত্যার মোটিভ উদ্ধার করে পুলিশ। বুধবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে হত্যার বর্ণনা দেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান আবদুল বাতেন। গ্রেফতার দুইজন হলেন, ১। রউফ ও ইনামুল ।

তাদের হেফাজতে হতে ভিকটিমের ব্যবহৃত ০১ টি ভাঙ্গা মোবাইল, হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত গামছা, বালতি ও লাশ মাটি চাঁপা দেয়ার জন্য গর্ত খোঁড়ার কাজে ব্যবহৃত কাঠের টুকরা এবং ১,২১,৫০০/- টাকা উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে পুলিশ।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য সম্পর্কে তিনি জানান, গ্রেফতারকৃতরা বনানীর ২৩ নং রোডের ৮২ নং বাসার সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কর্মরত ছিলো এবং তারা উক্ত বিল্ডিং এর ছাদে বসবাস করতো। একত্রে চাকরির সুবাদে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। তারা হাউজে বসবাসকারী বিত্তবান লোকদের জীবনযাত্রা দেখে আর নিজেদের দৈন্যদশা দেশে হতাশাগ্রস্ত হয়।

নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় বারবার কিভাবে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করা যায় তা ভাবতে থাকে। এক পর্যায়ে হত্যাকান্ডের বেশ কয়েকদিন আগে রউফ প্রস্তাব দেয় যে চীনা নাগরিক গাও বস অনেক বড় ব্যবসায়ী, অনেক টাকা পয়সা নিয়ে আসা-যাওয়া করে এবং ফ্ল্যাটে একা থাকে। তাকে শেষ করে দিয়ে যা নিতে পারব তা দিয়ে জীবনে কিছু করা যাবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা সুযোগ খুঁজতে থাকে। এদিকে তারা নিশ্চিত হয় যে, বিল্ডিংয়ে সিসিটিভি ক্যামেরাতে ভিডিও রেকর্ড হয় না। কারন হার্ডডিস্ক নাই।

গত ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর একবার তারা মি. গাও কে হত্যার চেষ্টা করে। ঐদিন তারা সন্ধ্যায় চীনা নাগরিক মি. গাও এর ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে কলিং বেল দেয়। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ দরজা না খোলায় ভয়ে তারা আবার ফিরে আসে। পরে চলতি বছরের ১০ ডিসেম্বর তারা পুনরায় পরিকল্পনা করে যে আজকে কাজ শেষ করতেই হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ইনামুল তার নিজের ব্যবহৃত গামছা সাথে নিয়ে যায়। মাগরিবের আযানের পরপরেই তারা মি.গাও এর ফ্ল্যাটের সামনে যায় এবং রউফ কলিং বেল এ চাপ দেয়। মি.গাও দরজা খুলে ওদের দিকে বিস্ময়ে তাকায়। তিনি বাংলা ও ইংরেজী ভাষাই জানতেন না। তবে ইশারায় জানতে চাচ্ছিলেন যে, কি বিষয়? তখন ইনামুল বলে water water. মানে বুঝাতে চায় যে তারা পানি খাবে। মুহুর্তের মধ্যেই তারা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে এবং ইনামুল গলায় গামছা পেচিয়ে ধরে এবং রউফ কোমরের দিকে জাপটে ধরে।

অল্প সময়ের মধ্যেই মি. গাও এর নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে যায়। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে মি. গাও রউফ এর বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে কামড়ে দেয়। তারা ২/৩ মিনিটের মধ্যেই মি. গাও এর মৃত্যু নিশ্চিত করে। ফ্ল্যাটের ভিতরে ড্রয়িং রুমের টেবিলের উপরে মি. গাও এর ল্যাপটপ খোলাই ছিলো এবং পাশে ছিল তার সার্বক্ষণিক সাথে থাকা একটি ছোট ব্যাগ। রউফ ওই ব্যাগটি খুলে সেখানে থাকা ৩টি ১০০০ টাকার বান্ডিল, কিছু খুচরা টাকা ও মোবাইল নিজেদের হেফাজতে নেয়। এরপর গাও এর মৃতদেহ ড্রয়িং রুম এ নিয়ে গামছা দিয়ে রক্ত মুছে দিয়ে বের হয়ে ছাদে চলে যায় ছাদে। সেখানে গামছা ধুয়ে ও নিজেরা গোসল করে একসাথে দুজনের বের হয়ে যায়।

পরে টাকা গণনা করে রউফ নেয় এক লাখ ছিয়াত্তর হাজার) টাকা এবং এনামুলকে দেয় এক লাখ তিহাত্তর হাজার টাকা। পরে তারা বনানী সুপার মার্কেটের পাশে একটি চায়ের স্টলে বসে চা খায় এবং টাকাগুলো কি করবে তা নিয়ে আলোচনা করে। পরে টাকাগুলো তারা ভাগ করে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। আবদুল বাতেন বলেন, ওই দিন রাতে রউফ নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে ডিউটিতে ছিল। রাত ১১টার দিকে ভবনের পেছনের দিকে বালু মাটিতে কাঠের টুকরো দিয়ে গর্ত করে ওপরে ওঠে। লাশ টেনে নিয়ে লিফট দিয়ে নামিয়ে মাটিচাপা দেয়।

ঘটনার একদিন পর গাউজিনের গাড়িচালক তার ব্যবহৃত স্যান্ডেলে রক্তের দাগ দেখে খোঁজা শুরু করেন। একপর্যায়ে চালক ভবনের পেছনে মাটিচাপা অবস্থায় পায়ের গোড়ালি দেখে পুলিশকে খবর দেন। ১১ ডিসেম্বর বনানীর ২৩ নম্বর রোডের ৮২ নম্বর ভবনের পেছনে মাটিচাপা অবস্থায় জে জিয়াং ফি নামে এক চীনা নাগরিকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

উল্লেখ্য যে, গাও একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি উক্ত ফ্ল্যাটে দীর্ঘ ১ বছর ধরে বসবাস করতেন। তিনি চীন থেকে পাথর ও নিমার্ণ সামগ্রী আমদানি করে পদ্মা সেতু ও পায়রা বন্দরে সাপ্লাই করতেন।