যে কুকুরটা যতো ছোট সে ততো বেশি ঘেউ ঘেউ করে। হাতি পেছনে নজর দেয় না কুকুর যতই ঘেউ ঘেউ করুক না কেনো। দুর্বল, ব্যর্থ, কাপুরুষ, মিথ্যাবাদি, ভীতু, ভীরু, লোভি, দুষ্টু এবং লো প্রফাইলের মানুষের রাগ যেমন বেশি তেমনি অতিরিক্ত কথা বলে অন্যকে কনভিন্স করার জন্য। এদের আচরণে মিথ্যে বলার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এরা সমাজের কলঙ্ক, অশিক্ষিত, কুলাঙ্গার। এদের দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় ব্যর্থতা আর হিংসাপরায়ণতা এদেরকে গ্রাস করেছে। এদের মুরাল ভ্যালুর অবক্ষয় হয়েছে। এরা সমাজের কাছে একদিকে অস্বস্তিকর ও অন্যদিকে হাস্যকর। এদের পেছনে যারা সর্বক্ষণ তাল মারে বা তাল মারতে চেষ্টা করে তাদের জীবনেও অন্ধকারের ছোঁয়া লেগেছে। এধরণের লোক প্রিয়জন তথা ভাই-বোন, স্ত্রী এমনকি নিজ সন্তান থেকে বিতাড়িত এবং নির্যাতিত। এরা সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য ভুলে গেছে এবং নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। এরা জীবনকে শেষ পর্যন্ত অর্থের বাহাদুরি দেখিয়ে অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চেষ্টা করে। এরা মানসিক রোগী, এরা সমাজের এক ধরনের অাগাছা যা পরিষ্কার করা দুস্কর। এরা প্রায় প্রত্যেক পরিবারে রয়েছে। এরা সমাজ, দেশ ও সর্বোপরি মানুষ জাতির কলঙ্ক। নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে এদের ভিতর এবং বাইরের এই কুৎসিত চরিত্র ফুটে উঠেছে। এদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হলো এরা অল্পতেই রেগে যায়।

রাগ সম্পর্কে আমরা কী জানি বা রাগ কী? কেন মানুষ রাগ করে বা রাগের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? কিভাবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বা আদৌ সম্ভব কি?  অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় রাগ একটি স্বাভাবিক আবেগ হলেও এর প্রকাশ যদি অনিয়ন্ত্রিত বা অন্যের জন্য ক্ষতিকারক অথবা অপ্রীতিকর হয়, তখন এটি নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য নয়। রাগের কারণে সম্পর্কের বিচ্ছেদ, বড় ধরনের শারীরিক ক্ষতি, অঙ্গহানি বা এমনকি কারও মৃত্যুর খবরও উঠে আসে খবরের কাগজে। তবে রাগের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিন্তু ব্যক্তি নিজেই। দূরত্ব তৈরি হয় তার পারস্পরিক সম্পর্কে, কমে যায় সম্পর্কের গুণগত মান অথবা কমে যায় তার প্রতি অন্যদের সম্মানবোধ, আগ্রহ। বিষণ্নতা, হীনমন্যতা বা অপরাধবোধে আক্রান্ত হয় ব্যক্তি। শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত রাগ কমিয়ে দিতে পারে দৈনন্দিন জীবনযাপনের স্বাভাবিক দক্ষতা, উৎপাদনশীলতা, যৌনক্ষমতা এবং শেষে ঘটতে থাকে মনুষ্যত্বের অবক্ষয়।

রাগ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানসিক দুরবস্থার একটি বহিঃপ্রকাশ। অন্যের প্রতি আক্রমণ নিজের প্রতি ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তির এক রকম আত্মরক্ষামূলক আচরণ (ডিফেন্স) মাত্র। ব্যক্তির অনিয়ন্ত্রিত রাগ মূলত পরিবেশ থেকেই আসে। অনেক সময় যেমন অন্যের আচরণ যখন পরিবার ও সমাজ কর্তৃক নানাভাবে উৎসাহিত হতে দেখে, সেটাও তাকে উৎসাহিত করে। রাগ মূলত আশাভঙ্গ এবং ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়া। বিশেষ করে আশাভঙ্গ বা বিফলতার মাত্রা যদি গ্রহণযোগ্য না হয় বা এর মাত্রা যদি গভীরতর হয় তখন তা রাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ব্যক্তি যদি কোনো বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপে থাকে, সে ক্ষেত্রেও তার অতিরিক্ত উদ্বিগ্নতা রেগে যাওয়ার মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

সামাজিক দক্ষতার অভাব, সমস্যা সমাধান বা দৈনন্দিন জীবনের নানামুখী চাপ ভালোভাবে মোকাবিলা করতে না পারা, অন্যের কাছে সঠিকভাবে প্রকাশের অদক্ষতা ইত্যাদি ব্যর্থতার দায় ব্যক্তি অনেক সময় কাছের মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। অনেক কাজ একসঙ্গে এসে গেলে অথবা অল্প সময়ের মধ্যে অনেক কাজ শেষ করতে গিয়ে সেসব যদি ঠিকমতো না হয়, তাহলে অনেকের মধ্যে টেনশন বা হতাশা জমতে জমতে রাগ তীব্র আকার ধারণ করে থাকে।

ছোটবেলা থেকেই মানসিক সমস্যা, যেমন ব্যক্তিত্বের ত্রুটি, বিষণ্নতা, উদ্বিগ্নতা, মিথ্যা বলা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতা, কনডাক্ট ডিসঅর্ডার হলে মানসিক এই ভয়ংকর রোগ রাগের উপসর্গ হয়। এ ছাড়া খুঁতখুঁতে স্বভাব, হীনমন্যতাবোধ, অতিরিক্ত কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব, সবকিছুতে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ, ব্যর্থতা মেনে না নেওয়ার মনোভাব ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের মানুষের মধ্যে অল্পতেই রেগে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। কীভাবে রাগ সামলানো সম্ভব? রাগ একটি নেতিবাচক আবেগ, যার কারণে যে ক্ষতি হতে পারে, সেটি আগে নির্দিষ্ট করতে হবে এবং পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তাৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া দেখানো থেকে বিরত থাকতে চেষ্টা করতে হবে, রেগে গেলে সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নিজের কাছে কিছু সময় নিতে হবে। এই সময়ক্ষেপণের ফলে উত্তেজনা বা রাগের তীব্রতা কমার সম্ভাবনা থাকবে। ফলে রাগান্বিত অবস্থায় যেমন ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া হয়, রাগ কমে যাওয়ার পরে সঠিকভাবে মনোভাব অন্যের কাছে পৌঁছাতে পারা সম্ভব। রাগ নিয়ন্ত্রণ করার অনেক উপায় রয়েছে, যেমন মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা এবং এ উদ্দেশ্যে নিয়মিত মেডিটেশন করা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, দ্রুতগতিতে প্রতিদিন অন্তত আধা ঘণ্টা জোরে ঘাম ঝরিয়ে হাঁটা বা দৌঁড়ানো ইত্যাদি। এ ছাড়া ১০০ থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে ১ পর্যন্ত গণনা করা, এক থেকে দু’বার শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করা, নামাজ পড়া, মিথ্যা না বলা বা পরের বদনাম না করা। জীবনের গুণগত মান অন্যের ওপরে নয়, নিজের ভালো থাকার ওপর নির্ভর করে। সুতরাং নিজেকে ভালোবাসতে শেখা, ভালো রাখতে চেষ্টা করা, গান শোনা, বই পড়া, পছন্দের কাজ গুলো করা। বন্ধুবান্ধব এবং সামাজিক মেলামেশা বাড়ানো, নিয়মিত দেশ-বিদেশ ঘোরা সর্বোপরি নিজের জন্য প্রতিদিনই কিছুটা সময় ব্যয় করা যাতে করে মানসিক ভারসাম্য বজায় থাকে।

কাজেই রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা আমাদের সকলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। সকলের মনে রাখা উচিত, রেগে যাওয়া মানে হেরে যাওয়া। রাগের বহিঃপ্রকাশ লো প্রোফাইল মানুষের পরিচয়, কারণ তারা নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ যার ফলে অল্পতে রেগে যায়। রাগ ব্যক্তির চরিত্রের এক প্রতিচ্ছবি, তাকে যদি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা যায় তবে তা ব্যক্তির জন্য কেবল ধ্বংসই ডেকে আনে।

রহমান মৃধা, দূরপরবাস সুইডেন