বিশে^র দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জমায়েত এবারের ৫৫তম বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় পর্ব নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে টঙ্গীর কহর দরিয়াখ্যাত তুরাগ নদীর তীরে শুরু হয়েছে। প্রথম পর্বের পর চারদিন বিরতি দিয়ে শুক্রবার বাদ ফজর থেকে আম বয়ানের মধ্য দিয়ে এ পর্ব শুরু হয়। তবে বৃহস্পতিবার মাগরিব নামাজের পর ময়দানের ছামিয়ানার নিচে জমায়েত হওয়া মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে অনানুষ্ঠানিক বয়ান শুরু হয়েছে। আগামী রবিবার জোহরের নামাজের আগে (পূর্বাহ্নে) আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এবছরের ৫৫তম বিশ্ব এজতেমা শেষ হবে। এপর্বের শেষদিনে হেদায়েতী বয়ান ও আখেরী মোনাজাত পরিচালনা করবেন ভারতের নিজামুদ্দিনের মাওলানা জামশেদ। বিশ্ব এজতেমার এ পর্বে (দ্বিতীয়) মাওলানা সা’দ কান্ধলভী তাবলীগ অনুসারী মুসল্লিরা অংশ নিচ্ছেন। তবে এবারের এজতেমায় অংশ নিতে মাওলানা সা’দ শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত এজতেমা ময়দানে পৌছেন নি। এরআগে গত ১০ থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত বিশ্ব এজতেমার প্রথম পর্বে মাওলানা জোবায়ের অনুসারী আলেম ওলেমা কওমীপন্থী তাবলীগ মুসল্লিরা অংশ নিয়েছেন।

নানা বিড়ম্বনাকে উপেক্ষা করে এবারের বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় পর্বে যোগ দিতে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসল্লী টঙ্গীর এজতেমা ময়দানে ছুটে আসেন। দলে দলে মুসল্লীদের এজতেমা ময়দানে আসা এখনো অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে মুসল্লীরা এজতেমা ময়দানে এসে নিজ নিজ খিত্তায় অবস্থান নিয়েছেন। এজতেমায় যোগ দিতে দেশ-বিদেশের আগত মুসল্লিদের পদচারনায় শিল্প শহর টঙ্গী এখন যেন ধর্মীয় নগরীতে পরিণত হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে এজতেমা মুখি মানুষের ঢল নামে টঙ্গীর দিকে। বাস, ট্রাক, ট্রেন, ট্রলারসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে মুসল্লিরা যোগ দিচ্ছেন এজতেমায়। এজতেমা ময়দানে মুসল্লিদের আসা এখনো অব্যাহত রয়েছে। আখেরি মোনাজাতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মুসল্লিদের এ ঢল অব্যাহত থাকে।

বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আমির প্রকৌশলী ওয়াসেফুল ইসলাম জানান, ভারতের নিজামুদ্দিন মারকাজের শীর্ষ মুরুব্বি মাওলানা সা’দ কান্ধলভি ‘পরিস্থিতি বিবেচনায়’ এবারও এজতেমায় আসছেন না। তবে নিজামুদ্দিন মারকাজের পক্ষ থেকে ৩২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ইতোমধ্যে এজতেমায় এসে পৌঁছেছেন। তাদের তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হচ্ছে এবারের এজতেমার এ পর্ব।

তিনি আরো জানান, এবারের বিশ্ব এজতেমার প্রথম পর্ব সম্পন্ন হওয়ার পর গত সোমবার মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীদের কাছ থেকে মাঠ বুঝে নেওয়া হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় দ্বিতীয় পর্বেও প্রস্তুতি। বুধবার থেকেই দেশ-বিদেশ থেকে লোকজন এজতেমা ময়দানে জড়ো হতে শুরু করেন।

স্থানীয়রা জানান, সা’দ কান্ধলভির নেতৃত্ব নিয়ে বিভক্তির জেরেই দুই বছর ধরে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পৃথকভাবে এজতেমা করে আসছে তাবলিগ জামাতের মাওলানা জোবায়ের ও সা’দ অনুসারীরা।

যারা বয়ান করলেন ॥
এজতেমা ময়দানের জিম্মাদার প্রকৌশলী শাহ মহিবুল্লাহ জানান, বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুক্রবার বাদ ফজর থেকে আমবয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বৃহস্পতিবার বাদ আছর থেকে বিশ^ এজতেমার বয়ান শুরু হয়েছে। বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় পর্বের প্রথমদিন শুক্রবার বাদ ফজর থেকে আম বয়ান করেন দিল্লীর মুফতি ওসমান। তার বয়ান বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মুফতি আব্দুল্লাহ মুনসুর। এরপর মুফতি আসাদুল্লাহ জু’মা নামাজের আগ পর্যন্ত বয়ান করেন। তার বয়ান তরজমা করেন মুফতি ওসামা ইসলাম।
দুপুরে এজতেমা ময়দানে জু’মার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জু’মার নামাজের ইমামতি করেন তাবলীগের শুরা সদস্য বংলাদেশের মাওলানা মোশারফ। বাদ জু’মা বয়ান করেন ভারতের নিজামুদ্দিনের মুফতি চেরাগ আলী। তার বয়ান বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা আশরাফ আলী। এরপর বাদ আসর বাংলাদেশের সূরা সদস্য নাসিম খান শাহাবুদ্দিন নাসিম এবং বাদ মাগরিব নিজামুদ্দিনের মাওলানা আব্দুস সাত্তার বয়ান করেন।

বিভিন্ন ভাষায় বয়ানের তাৎক্ষণিক অনুবাদ ॥
বিশ্ব এজতেমায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের তাবলিগ মারকাজের ১৫-২০জন শুরা সদস্য ও বুজর্গ পর্যায়ক্রমে বয়ান পেশ করেন। মূল বয়ান উর্দূতে হলেও এজতেমায় আগত বিভিন্ন দেশের-ভাষা মুসল্লিদের জন্য বাংলা, ইংরেজী, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসিসহ বিভিন্ন ভাষায় তাৎক্ষনিকভাবে অনুবাদ করা হচ্ছে। বিদেশী মেহমানদের জন্য মূল বয়ান মঞ্চের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বপাশে হোগলা পাটিতে বসেন। বিভিন্ন ভাষাভাষি মুসুল্লীরা আলাদা আলাদা বসেন এবং তাদের মধ্যে একজন করে মুরুব্বী মূল বয়ানকে তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে শুনান। বিদেশী মুসল্লিদের জন্য বিশ্ব এজতেমা ময়দানের উত্তর-পশ্চিম পাশে নিবাস তৈরি করা হয়েছে।

বৃহত্তম জু’মার নামাজ অনুষ্ঠিত ॥
বিশ্ব এজতেমার শুরুর দিন জু’মা বার হওয়ায় এজতেমা মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছে বৃহত্তম জু’মার জামাত। জু’মা নামাজের ইমামতি করেন তাবলীগের শুরা সদস্য বংলাদেশের মাওলানা মোশারফ। এদিনটি জুমা’ বার হওয়ায় সকাল থেকেই টঙ্গী ও আশপাশ এলাকার লাখো মুসল্লীর ঢল নামে টঙ্গীর তুরাগ তীরে। এজতেমায় যোগদানকারী মুসুল্লী ছাড়াও জু’মার নামাজে অংশ নিতে ঢাকা-গাজীপুরসহ আশে-পাশের এলাকার লাখ লাখ মুসুল্লী এজতেমাস্থলে হাজির হন। প্রথম পর্বের তুলনায় এপর্বে শীতের তীব্রতা কম হওয়ায় ভোর থেকেই রাজধানীসহ আশে-পাশের এলাকা থেকে এজতেমা মাঠের দিকে মানুষের ঢল নামে। জুমার নামাজ আদায় করতে রাজধানীর আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুল সংখ্যক মুসল্লি ছুটে আসেন। নামাজের আগেই এজতেমার পুরো প্যান্ডেল ও ময়দান কানায় কানায় ভরে যায়। এজতেমার মাঠ উপচিয়ে জামাত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মূল প্যান্ডেলের নিচে জায়গা না পেয়ে মুসল্লি¬রা ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডের পাশ ঘেঁষে এজতেমা মাঠের উত্তর দিকের রাস্তায় ও খোলা জায়গার উপর অবস্থান নেয়। এজতেমা ময়দান এবং এর আশপাশে এলাকায় যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু পাঞ্জাবি আর টুপি পড়া মানুষ আর মানুষ। বেশীর ভাগ মুসুল্লিকে খবরের কাগজ, জায়নামাজ, পলিথিন ও হোগলা বিছিয়ে জুমা’র নামাজ আদায় করতে দেখা গেছে। আয়োজকদের ধারণা, দেশের স্মরণকালের বৃহত্তম এ জুমার নামাজে অন্য বছরের তুলনায় এ বছর আবহাওয়া পরিস্থিতি অনুকূলে থাকায় এবার প্রায় ১৫ লক্ষাধিক মুসল্লি জুমার নামাজ আদায় করেছেন। বাদ ফজর হতে মাগরিব পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে দেশ-বিদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ ঈমান, আমল ও দাওয়াতের মেহনত স¤পর্কে অত্যান্ত ফজিলতপূর্ণ সারগর্ভ বয়ান করেন।

জুম্মার নামাজে ভিআইপি’দের অংশ গ্রহণ ॥
শুক্রবার জুম্মার নামাজের ইমামতি করেন তাবলীগের শুরা সদস্য বংলাদেশের মাওলানা মোশারফ। এদিন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এড. আ.ক.ম মোজাম্মেল হক, ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মোঃ ফজলে রাব্বী মিয়া, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, গাজীপুর জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম ও গাজীপুর মেট্রো পুলিশ কমিশনার মোঃ আনোয়ার হোসেনসহ বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এজতেমা ময়দানে জুম্মার নামাজে শরীক হন।

প্রথম দিনের বয়ানে যা বলা হয় ॥
বয়ানে বলা হয়, জুম্মারদিন, একটি পবিত্রদিন, সপ্তাহের সেরা দিন। সবচেয়ে উত্তম দিন হলো জুম্মার দিন। এটি হলো সবচেয়ে বড় ও সম্মানি দিন। এটি দু’ঈদের চেয়েও ফজিলতপূর্ণ। এদিনে হযরত আদম (আ.)কে সৃষ্টি করা হয়। এদিনই দুনিয়া ধ্বংস হবে। এদিনে আল্লাহ্র কাছে যা চাইবে, আল্লাহ তা তাকে দেবেন। জুমা’র নামাজ আদায়ের লক্ষ্যে গোসল-ওজু করে মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পর থেকে তার নেকী লেখা হয়। আমরা যা করবো আল্লাহকে রাজি করার জন্য করবো। আল্লাহ পাকের হুকুম মতো আমরা যেন সারা জীবন চলতে পারি সে চেষ্টা করতে হবে। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশে ও সারা দুনিয়ায় মানুষের মাঝে দীন কায়েম করার জন্য ছড়িয়ে পড়তে হবে।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা ॥
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোঃ আনোয়ার হোসেন জানান, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার বাজায় রাখার জন্য সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফায়ও বহাল রয়েছে আগের দফার প্রায় সকল প্রস্তুতি। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ৫টি স্তরে বিভক্ত করা হয়েছে। এজতেমা ময়দান ও আশেপাশের এলাকার নিরাপত্তায় ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে প্রায় ৯ হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পুরো এজতেমা ময়দান সিসি ক্যামেরা, ওয়াচটাওয়ারের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদ্যরা পর্যবেক্ষণ করছেন। এছাড়াও মেটাল ডিটেক্টর, ফুটপেট্রোল, মোবাইল পেট্রোল ও চেকপোষ্টসহ পোশাকে সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরা এজতেমা ময়দানের ভেতরে এবং বাহিরে দায়িত্ব পালন করছে। এজতেমায় পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব সদস্যরাও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন।

বিশ্ব এজতেমার কর্মসূচি॥
বিশ্ব এজতেমার কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আম ও খাস বয়ান, তালিম, তাশকিল, ৬ উছুলের হাকিকত, দরসে কোরআন, দরসে হাদিস, চিল্লায় নাম লেখানো, নতুন জামাত তৈরি।

আরো এক মুসুল্লীর মৃত্যু ॥
এবারের এজতেমায় যোগ দিতে আসা এক মুসুল্লী বৃহষ্পতিবার রাতে মারা গেছেন। তার নাম কাজী আলাউদ্দিন (৬২)। তিনি সুনামগঞ্জের দোয়ারা বাজার থানার চানপুর গ্রামের মৃত হযরত আলীর ছেলে। এ ছাড়াও এজতেমায় যোগ দিতে আসার পথে টঙ্গীতে গত বুধবার রাতে পৃথক দূর্ঘটনায় দু’মুসুল্লী মারা গেছেন। এদের মধ্যে টঙ্গী ষ্টেশনে রেললাইন পার হওয়ার সময় ট্রেনের ধাক্কায় গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার টেংরাকান্দি গ্রামের রমজান আলীর ছেলে গোলজার হোসেন (৪০) এবং মন্নু নগর এলাকায় সড়ক পার হওয়ার সময় কাভার্ডভ্যানের চাকায় পিষ্ট হয়ে নরসিংদীর বেলাবো থানার বীরবাগদে গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে সুরুজ মিয়া (৬০) নিহত হন।

বিদেশী মুসল্লি ॥
পুলিশের কন্ট্রোল রুম সূত্র জানায়, এজতেমার দ্বিতীয় পর্বের প্রথমদিন সকাল পর্যন্ত বিশ্বের ৩১টি দেশের প্রায় এক হাজার ৪শ’রও বেশি মুসল্লি শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত অংশ নিয়েছেন।

এজতেমার মুরুব্বীদের দেয়া তথ্যমতে, ১৯৪৬সালে প্রথম কাকরাইল মসজিদে এজতেমার আয়োজন শুরু করা হয়। তারপর ১৯৪৮সালে চট্টগ্রামের হাজী ক্যাম্পে ও ১৯৫৮সালে নারায়নগঞ্জের সিদ্ধরগঞ্জে এজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৬৬সালে গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বর্তমানস্থলে স্থানান্তর করা হয়েছে। পরে সরকারিভাবে তুরাগ তীরের ১৬০একর জমি স্থায়ীভাবে এজতেমার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়।

২০০৯ সাল পর্যন্ত ইজতেমা তিন দিন ধরে অনুষ্ঠিত হতো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মুসল্লিরা এই ইজতেমায় অংশ নেন বলে এটি বিশ্ব ইজতেমা হিসেবে পরিচিতি পায়। পরে মুসল্লিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০১০ সাল থেকে দুই দফায় তিন দিন করে ইজতেমার আয়োজন করা হতো। তাবলিগের আমির মাওলানা সা’দ কান্ধলভী ও মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীর বিরোধের কারণে গত বছর থেকে দুই পক্ষ আলাদাভাবে ইজতেমার আয়োজন করতে শুরু করে।

মোস্তাফিজুর রহমান টিটু, গাজীপুর থেকে ॥