অপরাধীদের ধরতে বিভিন্ন সময়ে নানা কৌশল অবলম্বন করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এসব কৌশল তারা সব সময়ই গোপন রাখার চেষ্টা করেন।তবে আলোচিত ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে আসামিদের গ্রেপ্তারের কিছু ব্যতিক্রমী কৌশল প্রয়োগ করে পুলিশ।

তেমনি একটি আলোচিত ঘটনা ছিল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ড. সারওয়ার আলীকে হত্যাচেষ্টা মামলা। এটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি মামলা ছিল। কারণ ঘটনার পরে এটিকে জঙ্গি হামলা হিসেবে প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল। এ মামলার বেশ কয়েকজন আসামি গ্রেপ্তারের পর জানা গেছে আসলে হত্যাচেষ্টার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন।

এই ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি তদন্ত শুরু করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।তদন্তের শুরুর পরেই তারা ফরহাদ নামের এক আসামি গ্রেপ্তার করে। কিন্তু এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী নাজমুলসহ অন্যদের গ্রেপ্তার করা ছিল তাদের বড় চ্যালেঞ্জ। সে কারণে নাজমুলকে গ্রেপ্তারের বিশেষ অভিযান চালিয়ে গত বুধবার দুপুরে উত্তরা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। এ সময় তার অন্য সহযোগী শেখ রনি (২৫),ফয়সাল কবির (২৬) ও মনির হোসেনকে (২০) গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

পালতক নাজমুলকে গ্রেপ্তারের পিবিআই উত্তরের ছয় সদস্যদের একটি টিম অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় আসামির অবস্থান শনাক্ত করে যখন তারা আসামির হাতে হ্যান্ডকাপ পড়ায় তখন আসামিসহ উপস্থিত সাধারণ মানুষরা অবাক হয়ে যায়। কারণ ওই আসামিকে গ্রেপ্তার করতে যাওয়া সবাই ছিলেন লুঙ্গি পরা ব্যক্তি।

সেই অভিযানে অংশ নেওয়া পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) আলামিন শেখ। তিনি বলেন, ‘আমাদের অভিযানের কৌশল হিসেবে আগে থেকেই লুঙ্গি পরে ওই এলাকায় ঘোরাফেরা করছিলাম। তাই আসামি তো আমাদের উপস্থিতি টের পায় নাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই আসামিকে যখন আমরা গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসি তখন উঁৎসুক অনেক মানুষ আমাদের দেখে নানা ধরনের মন্তব্য করছিলেন।’

আমার দুঃসাহসী দল-পিবিআই প্রধান

এই ঘটনার পরে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার তার ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। সেই পোস্টে তিনি ওই অভিযানে অংশ নেওয়া সকল লুঙ্গি পড়া পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের ছবিও দিয়েছেন। ওই ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘আমার দুঃসাহসী দল। (অভিযান পরবর্তী সময়) মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলীর উত্তরার বাসায় ডাকাতির প্রচেষ্টায় ৭ জনের মধ্যে দলনেতাসহ পাঁচজনকে বাগেরহাট, ত্রিশাল, গাজীপুর ও ঢাকা হতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তারা সকলেই আদালতে ১৬৪ ধারায় দোষ-স্বীকারমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছে। পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) দলের অভিযানকারী সদস্য ছিলেন যথাক্রমে (বাঁ থেকে) ইন্সপেক্টর জুয়েল মিয়া, ইন্সপেক্টর তরিকুল ইসলাম, সাব-ইন্সপেক্টর আল আমিন শেখ, ইন্সপেক্টর আশরাফুজ্জামান, সাব-ইন্সপেক্টর ফরিদ উদ্দিন ও ৬.কনস্টেবল সুযন মিয়া।’

ড. সারওয়ার আলী হত্যাচেষ্টা মামলার আদ্যোপান্ত

ড. সারওয়ার আলী হত্যাচেষ্টা মামলার পালতক আসামি নাজমুলসহ চারজনকে গ্রেপ্তারের পর পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার গতকাল বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে কয়েকটি ডায়রি উদ্ধার করা হয়েছে। এতে উগ্রবাদী কোনো লেখা পাওয়া যায়নি। মূলত ক্ষোভ থেকেই এই হামলা করা হয়। কারণ ২০১৭ সালে সারওয়ার আলীর স্ত্রীর গাড়ি চালিয়েছে নাজমুল। তার দাবি, তখন মানুষ হিসেবে প্রাপ্য সঠিক ব্যবহার পায়নি সে। ড্রাইভার হিসেবে চাকরি করাকালীন ডা. সারওয়ার আলীর স্ত্রী ডা. মাখদুমা নার্গিস তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন। এটি মানতে না পেরেই চাকরি ছেড়ে দেয় নাজমুল। চাকরি ছাড়ার পর থেকেই প্রতিশোধ নিতে নানা পরিকল্পনা করে সে।’

ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার আরও বলেন, ‘মূলত এরপর থেকেই ডা. সারওয়ার আলীর পরিবারকে উচিত শিক্ষা দেয়া ও ভয় দেখিয়ে ডাকাতির পরিকল্পনা করে নাজমুল। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ৫ জানুয়ারি রাতে উত্তরা-৭ নম্বর সেক্টরের বাড়িতে ঢুকে ডা. সারওয়ার আলীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যারচেষ্টা চালায় দুর্বৃত্তরা। তবে বাসার লোকজন ও প্রতিবেশীদের তৎপরতায় তিনি এ যাত্রায় প্রাণে রক্ষা পান।পরে এই ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা দায়ের করেন তিনি।’

পিবিআইর সূত্রে জানা যায়, আসামি নাজমুল ও ফরহাদসহ আরও কয়েক জন ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ ৪ জানুয়ারি রাজধানীর আশকোনা এলাকায় হজ ক্যাম্পের সামনে একটি হোটেলে নাস্তা করে ও হামলার পরিকল্পনা করে। ৫ জানুয়ারি বিকেল ৫টার দিকে আশকোনা এলাকার হোটেল রোজ ভ্যালির ৩০৩ নম্বর কক্ষে নাজমুলের নেতৃত্বে ওই ৭ দুর্বৃত্ত হামলার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করে।

ঘটনার মূলহোতা নাজমুল বাসার পরিবেশ, কক্ষ, পার্কিং প্লেস ইত্যাদি সম্পর্কে সবাইকে ব্রিফ করে এবং হামলার সময় কার কী ভূমিকা হবে তা বুঝিয়ে দেয়। নাজমুল অন্যদের জানায় যে, ডা. সারোয়ার আলীর বাসায় নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার রয়েছে।

ঘটনার দিনে গত ৫ জানুয়ারি রাতে ১০টা ২০ মিনিটে ডা. সারওয়ার আলীর উত্তরার বাসায় স্ত্রী ডা. মাখদুমা নার্গিসসহ রাতের খাবার শেষে টিভি দেখছিলেন। এ সময় বাসার তৃতীয় তলায় বসবাসরত তাদের মেয়ে ডা. সায়মা আলীর বাসার দরজায় অজ্ঞাতনামা ২ দুর্বৃত্ত এসে কড়া নাড়ে। সায়মা দরজা খুলতেই ওই দুই দুর্বৃত্ত অতর্কিত ভেতরে সায়মা, তার স্বামী মো. হুমায়ুন কবির ও নাতনি অহনা কবিরের গলায় ছুরি ধরে। এর পর তাদের মধ্যে একজন তার মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে চতুর্থ তলায় সারওয়ার আলীর বাসায় কড়া নাড়ে। তিনি দরজা খুলতেই জোর করে ঘরে ঢুকে সারওয়ার আলীকে মেঝেতে ফেলে গলায় ছুরি ধরে। ওই সময় তার স্ত্রী চিৎকার করলে তৃতীয় তলার অপর অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্ত চতুর্থ তলায় আসে। তার স্ত্রীর চিৎকার শুনে দ্বিতীয় তলার ভাড়াটিয়া মেজর (অব) সাহাবুদ্দিন চাকলাদার ও তার ছেলে মোবাশ্বের চাকলাদার ওরফে সজিব চতুর্থ তলায় আসে। সাহাবুদ্দিন চাকলাদার দুর্বৃত্তদের একজনকে জাপটে ধরে এবং তার ছেলে সজিব একটি গ্লাস হাতে নিয়ে অপর দুর্বৃত্তকে লক্ষ্য করে ছুড়ে মারে। দুর্বৃত্তরা এ সময় দ্রুত বাসা থেকে পালিয়ে যায়। তখন পর ডা. সারওয়ার আলীর মেয়ে ৯৯৯-এ ফোন দিলে দ্রুত উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ গিয়ে দুর্বৃত্তদের ফেলে যাওয়া একটি মোবাইল সেট, সাতটি চাপাতি, সিমবিহীন একটি মোবাইল, আইপ্যাড, নাইলনের দড়িসহ বিভিন্ন মাল উদ্ধার করে।