মার্চ মাস আসলেই সারাদেশবাসীর মত পাবনাবাসীর বুকও ধড়ফড় করে ওঠে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের স্মৃতিতে। যদিও মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে পাবনায় প্রতিরোধ যুদ্ধে ২শ’ পাকসেনাকে হত্যা করেছিল বীর বাঙালিরা। ২৫ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত ৪দিন ধরে এই যুদ্ধ চলে। ২৫ মার্চ রাতে গোপনে ২শ’ পাক সেনা পাবনা শহরে প্রবেশ করে। ওই দিন রাতেই পাবনা শহরের পুরাতন টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনে ও পাবনা বিসিক শিল্পনগরীতে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে পাকসেনারা। আরো ১টি ক্যাম্প স্থাপন করে শহরের পূর্বদিকে লস্করপুরের মাঠের একটি নতুন ভবনে। সেখানে পাহারায় ছিল ৪ পাকসেনা।

২৫ মার্চ ভোরে শহরে পাকসেনারা কারফিউ জারি করে। ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় পাবনা বাজার পাহারারত কাবুলিওয়ালাদের সহায়তায় তারা সংগ্রাম কমিটির নেতাদের বাড়িতে বাড়ীতে তলাশি চালায়। তার আগেই সংগ্রাম কমিটির নেতারা চলে গিয়েছিলো শহরের দণিাঞ্চলের পদ্মার চরে। এরপরেও পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে গ্রেফতার হন আওয়ামী লীগ নেতা তৎকালিন এমপিএ এড. আমিনুদ্দিন, ভাসানী ন্যাপ নেতা দন্ত চিকিৎসক অমলেন্দু দাী ও ব্যবসায়ী আবু সাঈদ তালুকদার। এদেশীয় দোসর আলবদর, আলসামসদের সহযোগীতায় গ্রেফতারকৃতদের নির্মম ভাবে অত্যাচার করে হত্যা করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী।

পাবনার তদানিন্তন জেলা প্রশাসক নূরুল কাদের খান ২৬ মার্চ সকালে অস্ত্রাগার খুলে স্বাধীনতাকামী সাধারন মানুষের হাতে অস্ত্র তুলে দেন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় কয়েক ট্রাক পাকসেনা অতর্কিতে পাবনা পুলিশ লাইন আক্রমণ করতে যায়। আগে থেকেই পুলিশ লাইনের চারপাশের ভবনগুলোতে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে অবস্থান করছিলেন সশস্ত্র যুবক, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। পাকসেনাদের ট্রাকগুলো জজকোর্টের কাছে পৌঁছামাত্র গর্জে ওঠে পাবনার মুক্তিকামী বীর জনতার অস্ত্র- শুরু হয় যুদ্ধ। এ যুদ্ধে বহু পাকসেনা নিহত হয়। এক পর্যায়ে পিছু হটাতে বাধ্য হয় পাকহানাদাররা।

২৮ মার্চ ভোরে চরাঞ্চল থেকে লাঠি, ফলা, সড়কি, বন্দুক প্রভৃতি অস্ত্রহাতে অসংখ্য কৃষক-জনতা পাবনা শহরে প্রবেশ করে। বিসিক শিল্প এলাকাতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে পাকিস্তানী সেনারা। একই অবস্থার সৃষ্টি হয় পুরাতন টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনেও। ২৯ মার্চ পাবনার আকাশে চক্কর দিতে থাকে যুদ্ধ বিমান। গোলাবর্ষণ শুরু করে বিমান থেকে। এ সময় অবরুদ্ধ থাকা জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে পাকসেনার পালাতে থাকে। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনের যুদ্ধে ২৭ জন পাকসেনা নিহত হয় মুক্তিকামী জনতার হাতে। পাবনা থেকে পালিয়ে যাবার সময় নিরস্ত্র বাঙালীর হাতে দাশুরিয়াতে মারা যায় ১ শ’ ৮০ জন পাকিস্তানী সেনা। নাটোরের দিক থেকে ১১টি ট্রাকে সাদা পোশাকের কিছু লোক সাদা পতাকা উড়িয়ে বিসিক এলাকায় যায়। পাকসেনারা সেই ট্রাকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে উঠে একই পথে অগ্রসর হতে থাকলে পথে পথে ব্যারিকেড ও যুদ্ধের সম্মুখীন হন তারা। নাটোরের গোপালপুরে পৌছাতেই সব পাকসেনা নিহত হয় স্বাধীনতকামী সাধারন মানুষের হাতে। ১০ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় পাকসেনারা পাবনা আসে। এর আগে ১২ দিন পাবনা ছিল হানাদার মুক্ত। মহান মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে বহু সংখ্যক নিরীহ নারী-পুরষ, শিশু নিহত হয় পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে। পাকসেনাদের নির্মম অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞের নিরব স্বাক্ষী হয়ে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে পাবনা জেলার আনাচে-কানচে বহু বধ্যভুমি। এসব বধ্যভূমিগুলোতে স্মৃতিস্তম্ভ আজও নির্মাণ হয়নি। অবশ্য, বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের সময়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্ত্বরে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ও জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমানের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের ‘স্মৃতিস্তম্ভ দূর্জয়’ পাবনা নির্মাণ করা হয়। আর কোন উন্নয়নের মুখ দেখেনি স্মৃতিস্তম্ভটি। সারা বছর অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকে এই স্মৃতিস্তম্ভ । স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের যথাযথ মর্যাদা ও মূল্যায়ন করা হয়নি। জীবিত মুক্তিযোদ্ধারাও আজ অবহেলিত। পাবনাসহ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বধ্যভুমিগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণ করে বর্তমান সরকার শহীদদের আত্নার শান্তি দেবে এটাই পাবনাবাসীর প্রত্যাশা।