করোনা ভাইরাসের এলার্মিং, এটাকিং এবং পরিত্রাণ পেতে জনসচেতনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশের মানুষকে ঘরে অবস্থান করার ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা প্রসংশনীয়। সচেতনতামূলক এই ক্যানভাসে পিছিয়ে নেই সামাজিক বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও। বাংলাদেশের সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দেশের অধিকাংশ মানুষ সচেতনতার অভাবে নিজ জীবনকে বারবার ঝুকির মধ্যে ফেললেও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এমনটা উন্নয়ন লক্ষ্য করা যায়নি। দেশের নাগরিক হিসেবে এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক।

করোনার আক্রমণ ও সংক্রমণ থেকে নিজে বাচার জন্য এবং অন্যকে নিরাপদ রাখার স্বার্থে নিজ আলয়ে অবস্থানের বিকল্প নেই এটা যেমন সত্য, “প্রয়োজন আইন মানেনা ” এটাও তেমন ধ্রুব সত্য। দুটি পদক্ষেপই শুধুমাত্র বাচার তাগিদে । অবরুদ্ধের কানুন ভঙ্গ করে নিরুপায় মুভমেন্টের এর উদ্দেশ্য, প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব এক, অভিন্ন এবং মৌলিক প্রয়োজনীয়তা ইঙ্গিত করে । বিশেষ করে দিন এনে দিন খাওয়া অধিকাংশ মানুষগুলোর কানুন ভঙ্গের পিছনে অনেক যুক্তি ও মৌলিক অভাববোধ লুকায়িত আছে। এই কনছেপ্ট মাথায় রেখেই মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে থাকেন। মাঠ পর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তা প্রান্তিক ও অসচেতন জনগোষ্ঠীর বাস্তবতা ও ম্যানিয়া বুঝে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে অধিকতর সহনশীলতা প্রদর্শন করে মানবিক বিষয়গুলোও সমুন্নত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকেন, যা আমরা দেখেছি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রসংশাও করেছি।

ব্যতিক্রমী এক ঘটনার জন্মদিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলেন যশোর মনিরামপুরের এসি ল্যান্ড সাইয়েমা হোসেন। আইন বাস্তবায়ন করা যেমন আবশ্যিক, গণমানুষের ম্যান্ডেটরি রিকয়ারমেন্ট বুঝে সলিউশন দেওয়টাও আইন বাস্তবায়নের উল্লেখযোগ্য দিক। কাউকে শতভাগ সুবিধা নিশ্চিত করে হয়তো শতভাগ ফিডব্যাক পাওয়ার আশা করা যায়, কিন্তু মৌলিক চাহিদার ঘাটতি রেখে শতভাগ হোম কোয়ারেনটাইন প্রত্যাশা করা রীতিমতো অবিবেচনাপ্রসূত একটি ব্যাপার। যদিও হোম কোয়ারেনটাইনের বিকল্প একবারেই নেই। কেউ মানছি, কেউ মানছি না। যারা মানছি, তারা সচেতন, যারা অমান্য করছি তারা সবাই কিন্তু অসচেতন নই। কিছু আছে প্রয়োজনের তাগিদেই আইনের প্রতি অবজ্ঞা।

ষাটোর্ধ দুইজন ভ্যান চালক প্রচলিত আইন অমান্য করে সেফগার্ড ইকুইপমেন্ট ছাড়াই পরিবারের সদস্যদের মৌলিক চাহিদা মেটানোর প্রয়োজনে নিরুপায় হয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন হয়তো কিছু একটা করতে। কিন্তু আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তার চোখকে ফাকি দিতে পারেনি ষাটোর্ধ দুইজন দিনমজুর। মাঠপর্যায়ের এই কঠিন মনিটরিং এর জন্য এসি ল্যান্ড হিসেবে সাইয়েমা হোসেন আসলেই প্রসংশা পাওয়ার উপযুক্ত। অর্থাৎ তিনি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবেই পালন করে যাচ্ছেন। কিন্তু বয়স, বাস্তবতা ও সিটিজেন চার্টারের সকল কম্পোনেন্ট বিবেচনায় না এনে তিনি সিনিয়র সিটিজেনের আওতাভুক্ত দুইজন প্রবীন মানুষকে যেভাবে কানধরে উঠবস করানোর নির্দেশনা দিয়ে এই অমানবিক ছবি নিজের মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ধারণ করার যে দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন, তা রীতিমতো প্রতিটি মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। এরাই ক্যাডার, এরাই বিবেচক, এরাই দেশের চালিকাশক্তি। বাহ। তিনি হয়তো জানেন না ” মানবাতা আর আইন যমজ ভাই”।” ক্ষুধার্ত পেট আইন বাস্তবায়নের জন্য অন্তরায় “।

করোনা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাচার জন্য জনসমাগম নিরুৎসাহিত করার ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের ভূমিকা ও সহনশীলতা নিয়ে গতকাল বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগের সহকারী কমিশনার ( মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশন) জনাব পলাশ রহমানের একটি লেখায় প্রশাসন ও আমজনতার ভূমিকা, সহনশীলতা ও করনীয় নিয়ে চমৎকার লেখাটি পড়েছিলাম। যেখানে আইনের প্রয়োগে মানবতা ও মৌলিক প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি খুব ভালভাবেই ক্লারিফাই করা ছিলো। তিনিও বিসিএস ৩৪ ব্যাচের পুলিশ ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা এবং এসি ল্যান্ড সাইয়েমা হোসেনও ৩৪ ব্যাচের এডমিন ক্যাড্যারের একজন কর্মকর্তা। উভয়ের মধ্যে যোগ্যতার ফারাক শুধু চেতনায় আর প্রয়োগ বিধিতে।

এসি ল্যান্ড সাইয়েমা হোসেনের উচিত ছিলো দুইজন দিনমজুরের সাথে কথাবলে তাদের জিস্ট রিকয়েরমেন্ট উদঘাটন করে শান্তিপূর্ণ সমাধান দেওয়া। মৌলিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে আইন অমান্য করে রাস্তায় বেরোনোর যুক্তিকতা থাকলে সরকারি কোষাগার থেকে ইন্সট্যান্ট কিছু আর্থিক সাহায্য দিয়ে তিনি ঘটনার ডিসপোজাল দিতে পারতেন , অথবা অন্যকোন ম্যাসিভ অফেন্স করে থাকলে মোবাইল কোর্টের প্রচলিত আইনের মাধ্যমে সাজা নিশ্চিত করতে সামর্থ্য ছিলেন। কিন্তু দৃশ্যমাণ অবয়বে বয়স বিবেচনায় সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে উভয়কে কানধরা অবস্থায় উঠবস করার যে অমানবিক ও করুন দৃশ্য বিশ্ববাসিকে দেখার সুযোগ করে দিলেন, তাতে সকলের বিবেকে ঝাকুনি লাগলেও ওনার কতটুকু অনুশোচনা হয়েছে তা ছবিই প্রমাণ করে। খেটে খাওয়া মানুষগুলোর শিক্ষার অভাববোধ যেমন রয়েছে তেমন ফান্ডামেন্টাল ক্রাইসিসও রয়েছে বিধায় এরা ন্যাচারালি অন্যদের তুলনায় কম সচেতন ও গোয়ার্তমির কিছু ম্যানিয়া লালন করে থাকে। এদের সচেতন করা একদিনে সম্ভব নয় বিধায় কেইস স্ট্যাডি করে আরও সহনশীলতার পরিচয় দেওয়া মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনের দায়িত্ব বলেও প্রতীয়মান।

করোনা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাচার জন্য জনসমাগম থেকে বিরত থাকা সকলের যেমন দায়িত্ব, পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ঘরে আটকে রাখতে হলে রাষ্ট্রযন্ত্রের সাবসিডি নিশ্চিত করেই আইনের প্রয়োগ করা প্রশাসনের কর্তব্য । পেটের ক্ষুধা যখন নিপীড়ন শুরু করে, আইন তখন নিষ্পেষিত হয়ে অপপ্রয়োগে মানুষকে উৎসাহিত করে। ” Necessity knows no law ” এটার প্রয়োজনীয় সদ্ব্যবহার করতে গিয়েই হয়তো ষাটোর্ধ দুজনের ভাগ্যের এই কালিমা লেপন জাতির দেখার দূর্ভাগ্য হয়েছে। পিএসসির সুপারিশকৃত সকল ক্যাডারকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে তৈরি করতে বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ( বিপিএটিসি) এর দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণই যথেষ্ট বলে মনে হয়। কিন্তু এই প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরে মাঠ পর্যায়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা কিভাবে মানুষের মূল্যবোধের জায়গাটিকে সম্মান না করে কুরুচিপূর্ণ আইন প্রয়োগে উদ্দুদ্ধ হয়, সে বিষয়টি অনেকের নিকট প্রশ্নবিদ্ধ।

দাদার গল্পে শুনেছি বৃটিশ শাসনামলে ক্যাডারে মেধা তালিকায় স্থান পাওয়াদের চৌদ্দগোষ্ঠীর সার্বিক অবস্থা ও ফ্যামেলি স্ট্যাটাস রিভিউ করে উপযুক্ত মনে করলে চুড়ান্ত ভাবে যোগদানের সুযোগ দিতো। কারণ ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধারণ করার সক্ষমতা যাদের মধ্যে নেই, তাদের থেকে প্রয়োজনীয় আউটপুট পাওয়ার যোগ্যতার ও নাকি অভাব রয়েছে। এই ঘটনার ক্ষেত্রে এসি ল্যান্ড সাইয়েমা হোসেন বিবেকের কোন মানদণ্ডকে প্রায়োরিটি দিয়ে এমন ঘৃনিত শাস্তি নিশ্চিত করেছেন, তা ওনার নিজস্ব এসেসমেন্টই কেবলমাত্র বলতে পারবে। মানবতার দৃশ্যমাণ বিলুপ্তি পাবলিক সেন্টিমেন্টকে উসকে দেয়, এই কথাগুলো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে তিনি কতটুকু অনুধাবন করেছেন, তা জনগণ পরখ করার সুযোগ না পেলেও সরকারের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ হয়তো নিরপেক্ষতা নিয়ে নির্ভেজাল সমাধান দিবেন।

আমরা জানি খামখেয়ালিপনা লালিত এই জাতিকে নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা খুবই জটিল। কিন্তু জটিলতার মধ্যেও ইন্টেলেকচুয়াল হয়ে নিজ মেধার পজেটিভ স্বাক্ষর দৃশ্যমাণ হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে যেমন আমরা পুস্পমাল্য দিয়ে বরণ করে নিতে আন্তরিকতার ঘাটতি দেখাইনা, ঠিক লোম হর্ষক কোন কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ হিসেবে ধিক্কার জানাতেও পিছপা হইনা। ষাটোর্ধ মানুষদ্বয়ের প্রতি এমন নির্দয় ও অপমানজনক আচরণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ভূল সিদ্ধান্ত ছিলো কি না জানিনা, তবে মূল্যায়ন ও মানদণ্ডের বিচারে যোগ্যতার যথেষ্ট ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে অফেন্সের মাত্রার পাশাপাশি বয়সও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা আইনের গতি শিথিল করে মানবতাকে জাগ্রত করে থাকে। সংকটাপন্ন পরিস্থিতি বিবেচনায় এবং বয়সের লেভেল অনুধাবনে বিষয়টি এখানেই লক্ষ্যনীয় ও মার্জনীয় হতে পারতো।

আমজনতা হিসেবে আমাদের সচেতনতা আরও বৃদ্ধি করা দরকার। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আইনের প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল হয়ে প্রশাসনকে সহযোগিতার মানসিকতা জোরদার করা প্রয়োজন। এটার ব্যত্যয় ঘটলে এমন আরও অসংখ্য লজ্জাজনক চিত্র দেখার অপেক্ষায় থাকতে হতে পারে, কিন্তু এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি আমরা চাইনা। সকলের শুভ বোধোদয় হোক। সংকটাপন্ন এই পরিস্থিতি থেকে আল্লাহ সকলকে সুরক্ষিত রাখুক। আইন বাস্তবায়নের পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধের জায়গাটুকু সমুন্নত থাকুক। প্রিয় বাংলাদেশ এগিয়ে যাক কাঙ্খিত লক্ষ্যে সকলকে নিরাপদ রাখার প্রত্যয়ে।

মোস্তাফিজুর রহমান।
গোপালগঞ্জ।