করোনা ঝুকি নিয়েই গাজীপুরের পৌণে তিন শতাধিক মিল কারখানা সোমবার খোলা ছিল। সরকারি নির্দেশ অমান্য করে কিছু সংখ্যক লোকজন ঘর থেকে রাস্তায় বের হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুকি এড়াতে জেলার বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের ১৪টি পয়েন্টে সোমবার বসানো হয়েছে চেক পোস্ট। সড়কগুলোতে গণপরিবণ চলাচল না করলেও পণ্যবাহী কভার্ডভ্যান ও ট্রাক চলাচল করেছে। তবে এদিন নানা অজুহাতে কিছু সংখ্যক প্রাইভেটকার, অ্যাম্বুলেন্স, পিকআপ, মোটরসাইকেল, অটো রিক্সা ও রিক্সাকে চলাচল করতে দেখা গেছে। এদিকে জনসমাগম ঠেকাতে জেলার বিভিন্ন সড়ক এবং বাজার ও নিত্য প্রয়োজনীয় দোকান সমূহ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।

এলাকাবাসী, শ্রমিক ও পুলিশ জানায়, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে পোশাক কারখানা সমূহের ছুটি দ্বিতীয় দফায় এক সপ্তাহ বাড়িয়ে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়। প্রথম দফায় ২৬ মার্চ থেকে ৪এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। ছুটি ঘোষণার বাধ্যবাধকতা না থাকায় করোনা সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যেও প্রথম থেকেই গাজীপুরের প্রায় তিনশ’ মিল কারখানা তাদের উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এসব কারখানায় কয়েক লাখ শ্রমিক কাজ করছে। এক্ষেত্রে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের সব নিয়ম পালিত হচ্ছে না। এদিকে প্রথম দফার ঘোষণা অনুযায়ী ১০দিন ছুটি কাটিয়ে রবিবার কাজে যোগ দিতে লাখ লাখ শ্রমিক দুর দুরান্ত হতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গাজীপুরে আসে। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় এক সপ্তাহ ছুটি বৃদ্ধি করায় ওইসব শ্রমিকদের অধিকাংশই আবারো গ্রামের বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। পথে তারা বিভিন্নস্থনে জড়ো হয়ে অপেক্ষার পর গাঁদাগাঁদি হয়ে গাড়িতে চড়েছে। এতে পুরোপুরি নিয়ম কানুন না মেনে বিপুল সংখ্যক লোক সমাগম ও তাদের চলাচল এবং আসা-যাওয়ার কারণে করোনা সংক্রমণের আতংক গাজীপুর বাসীর মাঝে দেখা দিয়েছে।

গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশের ইন্টিলিজেন্স শাখার ইনচার্জ ইন্সপেক্টর মোঃ ইসলাম হোসেন জানান, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ি গাজীপুরের বিভিন্ন কারখানা ছুটি ঘোষণা করে বন্ধ রাখা হয়। তবে সোমবার পর্যন্ত জেলার নলজানী এলাকার (জিএমপি হেডকোয়ার্টারের সামনে) কোজিমা গার্মেন্টস, দক্ষিণ সালনার মোল্লাপাড়া এলাকার টিএমএস ফ্যাশন, ডেগেরচালা এলাকার এমাজিন ফ্যাশন, শ্রীপুরের বহেরারচালা এলাকার নান্তাবুর গ্রুপের তাকওয়া গার্মেন্টস, বড়বাড়ি এলাকার পাক ষ্টার বাংলাদেশ লিমিটেড সহ ২৭৭টি কারখানার উৎপাদন অব্যহত রয়েছে। কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে তাদের এসব কারখানা খোলা রেখেছেন।

জিএমপি’র ট্রাফিক পুলিশের (দক্ষিণ) সহকারি কমিশনার পীযূষ কুমার দে জানান, গাজীপুরের সড়ক-মহাসড়কে পণ্যবাহী কভার্ডভ্যান, ট্রাক, অ্যাম্বুলেন্স ও চিকিৎসকের গাড়ি ছাড়াও দুই/একটি অটোরিকশা ছাড়া যাত্রীবাহী কোন যানবাহন চলছে না। চলতে গেলে তা আটকে দেয়া হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। তারপরও কিছু মানুষ ঘর ছেড়ে পথে চলছে। আসলে করোনা সংক্রমনের জন্য মানুষের মাঝে যতটুকু সচেতনতা থাকা দরকার তা নেই। এখনও এক শ্রেণির মানুষ ও যানবাহন শুন্য মহাসড়ক খালি পেয়ে ঘুরতে বেরোয়। আবার অনেকে পিক-আপে চড়ে দূর-দূরান্তে যাওয়ার চেষ্টা করে। সকালে এরকম কিছু যানবাহনের চালককে সতর্ক ও সচেতন করা হয়েছে এবং কয়েকটির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

গাজীপুরের শ্রীপুরের মাওনা-চৌরাস্তা এলাকায় সোমবার সকালে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া এলাকার জমিলা খাতুন। সোমবার সকালে তার বাবার মৃত্যু খবর পেয়ে তিনি বাড়ি যাওয়ার জন্য গাড়ির অপেক্ষা করছেন সেখানে। তিনি বলেন, প্রায় দুই ঘন্টা ধরে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু দুই-একটি অটোরিকশা ছাড়া যাত্রীবাহী কোন গাড়ি চলছেনা। অন্যদের সঙ্গে পিক-আপ উঠলে কিছুদুর যাওয়ার পরই পুলিশ সকলকে নামিয়ে চালকসহ পিক-আপটি নিয়ে গেছে। ফলে হেঁটেই রওনা হয়েছি। জানিনা বাবার মুখ দেখতে পাব কি-না। শ্রীপুরের ধনুয়া এলাকার রিদিশা নীট কারখানার শ্রমিক মো. সাইদুল ইসলাম জানান, স্থাানীয় একটি মেসে থেকে কারখানায় কাজ করি। কিন্তু কারখানা বন্ধ দেয়ার পর রান্না করার বুয়াও চলে যায়। এতে থাকা-খাওয়ার কষ্টের কারণে গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ইশ^রগঞ্জ এলাকায় যাওয়ার জন্য রাস্তায় বের হই। শ্রীপুরের নয়নপুর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তরে জৈনাবাজার পর্যন্ত হেঁটে গিয়েও কোন গাড়ি পাইিনি। তাই চিন্তা করছি থেমে থেমে হেঁটেই গন্তব্যে যাব।

গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ রাসেল জানান, পুরো গাজীপুরে বাইরের কোন যানবাহন চলাচল করতে দেয়া হচ্ছে না। এজন্য গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর, শ্রীপুরের জৈনা বাজার, কালিয়াকৈরের চন্দ্রা (স্কয়ার কারখানার সামনে) এবং কালীগঞ্জের উলুখোলা এলাকায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে যাতে জরুরী সেবার গাড়ি ছাড়া অন্য কোন গাড়ি গাজীপুরে ঢুকতে এবং বাইরে যেতে না পারে। তবে কোন জরুরী কাজে কেউ যদি নিজস্ব গাড়িতে তাদের গ্রামের বাড়ি যেতে চান সেক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা দেখানো হচ্ছে। তবে দুই শ্রেণির মানুষকে রাস্তায় নামতে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে একটি হলো নি¤œশ্রেণি-পেশার মানুষ, যাদেরকে টাকা বা খাবারের প্রয়োজনে রোজগারের জন্য বাইরে চলতে দেখা গেছে। অন্যরা হলে উচ্চ শ্রেণির মানুষ, তারা নানা অজুহাতে গাড়ি নিয়ে বাইরে চলতে চেষ্টা করছেন।

তিনি এসময় উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, গাজীপুর সদরের উচ্চবিত্তের এক ব্যক্তিকে আটক করলে ওই ব্যক্তি পুলিশকে জানায়, পোশাক কারখানায় পিপিই, মাস্ক তৈরি করা হচ্ছে সেখানে তাকে যেতে হবে। অপর এক যাত্রী প্রাইভেটকারে স্বপরিবারে বের হয়েছেন ডাক্তারের কাছে যাবেন বলে। পরে চিকিৎসা পত্র যাচাইকালে দেখা গেছে তাতে ফ্লুইড দিয়ে দুই বছর আগের তারিখ মুছে হাল সনের তারিখ লেখে নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছে অন্য কাজে।

গাজীপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. আনোয়ার হোসেন জানান, মহানগরের ঢাকা-ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল মহাসড়কের টঙ্গীর স্টেশনরোড, গাজীপুরা, বোর্ডবাজার, চান্দনা-চৌরাস্তা, বিআরটিসি ক্রসিং, শিববাড়ি, রাজবাড়ি, কোনাবাড়ি ও রাজেন্দ্রপুর এলাকায় চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় যানবাহন চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। তবে এখনও কিছু লোক শাখা সড়কে অটো রিকশা, সিএিনজি চলার চেষ্টা করছে। তবে কাঁচা বাজার, জরুরী চিকিৎসা, ব্যাংক বা কারখানার কথা বলে নানা লোকজন চলাচল করছে। তবে আমাদের এসব ব্যাপারে আরো কড়াকড়ি হতে হবে। জেলার কাঁচাবাজারসহ বিভিন্ন বাজারগুলোতে জনসমাগম বেশি হচ্ছে। করোনা সংক্রমন নিয়ন্ত্রণে কাঁচা বাজারও একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা রেখে মানুষ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দুপুর দুইটার পর কোন দোকানপাট খোলা থাকবে না। আমাদের আরো সচেতন হতে হবে।

গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. খায়রুজ্জামান জানান, গাজীপুরে ১০ মার্চ হতে সোমবার পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠাণিক ও হোম কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন মোট ২৬৩৮জন। এরমধ্যে গত ২৪ ঘন্টায় ৩৩জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে ২৫৫৬জন ছাড়পত্র পেয়ে ইতোমধ্যে বাড়ি ফিরে গেছেন। জেলায় এপর্যন্ত দু’জনের শরীরে করোনা ভাইরাস সনাক্ত হয়েছে। তাদেরকে আইসোলেশনের জন্য রাজধানী উত্তরার বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নেওয়া হয়।