গাজীপুরে করোনা ভাইরাস সংক্রমন প্রতিরোধে ঘোষিত লকডাউনের মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে রবিবার প্রায় সাড়ে ৪শ’ পোশাক কারখানা খুলেছে। এসব কারখানার শ্রমিকরা দুর দুরান্ত থেকে এসে কাজে যোগ দিয়েছে। তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছেনা করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখাসহ নিয়ম কানুন। অপরদিকে গত কয়েকদিনের মতো রবিবারেও বিভিন্ন দাবীতে কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছে। এসময় তারা মহাসড়ক অবরোধ ও একটি কারখানার বিভিন্ন মালামাল ভাংচুর করেছে। এতে গাজীপুরে করোনা সংক্রমন ঝুকি বেড়েই চলছে গাজীপুরে।

গাজীপুর শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুশান্ত সরকার জানান, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য গত ১১ এপ্রিল গাজীপুর জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকেই গাজীপুরে প্রায় সব পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিকদের অনেকেই তাদের গ্রামের বাড়ি চলে যায়। সম্প্রতি সরকার স্বল্প পরিসরে কারখানা খুলে দেয়ার ঘোষণা দিলে বিভিন্ন উপায়ে কারখানা শ্রমিকরা ফের গাজীপুরে ফিরে আসেন। রবিবার গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় ৪৩৮ টি পোশাক কারখানাসহ প্রায় সাড়ে ৪শ কারখানা চালু হয়েছে। এসব কারখানা খুলে দেয়া হলেও কিছু কারখানা কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলছেন। স্বাস্থ্যবিধি রক্ষায় তারা শ্রমিকদের গায়ে স্প্রে করে দিচ্ছেন, থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে জ্বর পরীক্ষা করে কর্মীদের কারখানায় ঢুকতে দেয়া হচ্ছে। এছাড়া সবার হাত ধোয়া এবং মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে অনেক কারখানায় শ্রমিকদের প্রবেশ ও বের হওয়ার সময়, কারখানায় কাজের সময় এবং যাতায়াতের সময় সামাজিক দূরত্বসহ করোনা প্রতিরোধের নানা নিয়ম কানুন মানা হচ্ছে না। শ্রমিকরা রিকশায় ও রাস্তায় গাদাগাদি করে চলাফেরা করছে। তবে শিল্প পুলিশ কারখানাগুলি তদারকি করছে, যাতে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের নিয়ম কানুন বাস্তবায়ন হয় এবং কোনো কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি না হয়।

গাজীপুর শিল্প পুলিশের ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীর হোসেন, শ্রমিক ও স্থানীয়রা জানান, গাজীপুর সদর উপজেলার ভাওয়াল মির্জাপুরের তালতলী এলাকার এডিসন ফুট ওয়্যার লিমিটেড কারখানা কর্তৃপক্ষ রবিবার হতে চালু করেছে কর্তৃপক্ষ। এজন্য রবিবার হতে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য কারখানাটির শ্রমিকদের সংবাদ দেওয়া হয়। কারখানায় প্রায় দু’হাজার শ্রমিক রয়েছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে কারখানাটি গত কয়েকদিন বন্ধ ছিল। সংবাদ পেয়ে শ্রমিকরা কাজে যোগ দেওয়ার জন্য রবিবার সকাল হতে কারখানার গেইটে এসে জড়ো হতে থাকে। এসময় এ কারখানায় যাদের চাকুরিকাল তিনমাসের বেশী তাদেরকে কাজে যোগ দিতে দেওয়া হয়। অবশিষ্টরা কাজে যোগ দিতে না পেরে কারখানার গেইটে অবস্থান করতে থাকে। দীর্ঘক্ষণ গেইটে অপেক্ষা করেও কর্তৃপক্ষের কোন সাড়া না পেয়ে তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এসময় তাদেরকে (চাকুরিকাল তিনমাসের কম) কারখানা থেকে ছাটাই করা হয়েছে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজিত হয়ে উঠে এবং বিক্ষোভ শুরু করে। একপর্যায়ে উত্তেজিত শ্রমিকরা কারখানার গেইট ভাঙ্গার চেষ্টা করে। এসময় তারা ইটপাটকেল ছুড়ে এবং কারখানার সিসিটিভি ক্যামেরা ও দরজা জানালার কাঁচসহ বিভিন্ন মালামাল ভাংচুর করে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছে দুপুরের দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। একপর্যায়ে শ্রমিক অসন্তোষের মুখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগামী ১মে পর্যন্ত কারখানা ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।

গাজীপুর শিল্প পুলিশের ইন্সপেক্টর শহিদুল ইসলাম ও শ্রমিকরা জানান, গাজীপুর মহনগরীর ভোগড়া এলাকার স্টাইলিশ গার্মেন্টস কারখানাটি চালু করার নির্ধারিত তারিখ ঘোষণার দাবীতে শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেছে।
পুলিশ ও শ্রমিকরা জানায়, গত ৩১ মার্চ এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্টাইলিশ গার্মেন্টস কারখানাটি ১এপ্রিল হতে লে-অফ ঘোষণা করে। অথচ কারখানাটিতে ১ এপ্রিলের পরও কিছুদিন পর্যন্ত উৎপাদন অব্যহত ছিল। লে-অফ শেষে কারখানাটি কবে নাগাদ খোলা হবে তা ঘোষণা দেয়নি মালিক পক্ষ। শ্রমিকদের দাবী, সরকার ঘোষিত প্রণোদনার সুবিধা নেওয়ার জন্য মালিক পক্ষ হঠাৎ কারখানাটি লে-অফ ঘোষণা করে। এতে শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে।
তারা আরো জানান, বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কারখানাটি চালু করার নির্ধারিত তারিখ ঘোষণার দাবীতে রবিবার সকাল হতে বিক্ষোভ শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা কারখানার পার্শ্ববর্তী ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উপর অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করে। এতে মহাসড়কের উভয়দিকে যানবাহন আটকা পড়ে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছে। পুলিশ দুপুরের পর পর্যন্ত কারখানার মালিক পক্ষের সঙ্গে চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়। একপর্যায়ে সমস্যা সমাধানের জন্য পুলিশ কর্মকর্তাগণ মালিক পক্ষের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাস দিলে বিকেলে শ্রমিকরা অবরোধ তুলে নিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

এদিকে দ্বিতীয়দিনেও (রবিবার) গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বাড়ইপাড়া এলাকার হেচং বিডি লিমিটেড পোশাক কারখানার শ্রমিকরা তাদের ওই দু’মাসের বকেয়াসহ পাওনাদি পরিশোধ এবং কারখানা চালু করার দাবীতে বিক্ষোভ শুরু করেছে।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের ইন্সপেক্টর রেজাউল করিম, শ্রমিক ও স্থানীয়রা জানান, গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বাড়ইপাড়া এলাকার হেচং বিডি লিমিটেড পোশাক কারখানাটি গত নবেম্বর মাসে লে-অফ ঘোষণা করে বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। বন্ধ ঘোষণার সময় গত অক্টোবর ও নবেম্বর মাসের বেতন ভাতাসহ শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনাদি পরিশোধ করে নি কর্তৃপক্ষ। গত কয়েকদিন আগে কারখানাটি শনিবার (২৫ এপ্রিল) চালু এবং আগামী ৭মে শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনাদি পরিশোধের তারিখ ঘোষণা করে গেইটে নোটিশ টানিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। এরপ্রেক্ষিতে শনিবার সকাল হতে শ্রমিকরা কারখানার গেইটে এসে জড়ো হয়। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ অবস্থানের পরও কারখানায় মালিক পক্ষের কাউকে না পেয়ে এবং কারখানার গেইট খুলে না দেওয়ায় শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। এসময় তারা তাদের ওই দু’মাসের বকেয়াসহ পাওনাদি পরিশোধ এবং কারখানা চালু করার দাবীতে গেইটে বিক্ষোভ শুরু করে। এক পর্যায়ে শ্রমিকরা কারখানার পার্শ্ববর্তী ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের উপর গিয়ে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধের চেষ্টা চালায়। এসময় পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছে মালিক পক্ষের সঙ্গে আলোচনার আশ্বাস দিলে তারা বাড়ি ফিরে যায় এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

তিনি আরো জানান, কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুর এলাকায় আরএল ইয়ার্ণ ডায়িং কারখানার শ্রমিকরা মার্চের বেতন ভাতা পরিশোধের দাবিতে রবিবার সকালে বিক্ষোভ শুরু করে। পরে কর্তৃপক্ষ আগামী ২ মে কারখানা খোলার পর বেতন পরিশোধের তারিখ ঘোষণার আশ^াস দিলে শ্রমিকরা আন্দোলন স্থগিত করে এলাকা ত্যাগ করে।
একই ভাবে টঙ্গী দত্তপাড়া এলাকায় ব্রাইট অ্যাপারেলস লিমিটেড ২৬ মার্চে কোন খোলার তারিখ না দিয়ে কারখানা লে-অফ ঘোষনা করে ফটকে নোটিশ টানিয়ে দেয়। কিন্তু ২৬মার্চ অনেক কারখানা খুললেও ওইটি খুলেনি। রোববার সকালে কারখানাটি খুলে দিতে কিংবা খোলার তারিখ নির্ধারণের দাবিতে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে।

গাজীপুরের শিল্পাঞ্চল পুলিশের এসপি মো. সিদ্দিকুর রহমান জানান, গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় দুই হাজার ৭২টি শিল্প কারখানার রয়েছে। এরমধ্যে রবিবার বিজিএমইএ ভুক্ত ২৩৮টি, বিকেএমইএ ভুক্ত ৩১টি ও বিটিএমই ভুক্ত ২৪টি এবং অন্যান্য সংগঠণভুক্ত ১৪৫টিসহ মোট ৪৩৮ টি পোশাক ও বিভিন্ন কারখানা চালু হয়েছে। অবশিষ্ট একহাজার ৬৩৪টি কারখানা রবিবার পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে। জেলার কারখানাগুলোর মধ্যে রবিবার সকাল পর্যন্ত এক হাজার ৭৮৬টি কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করেছে কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে বিজিএমইএ-এর ৮৩০টি কারখানার মধ্যে ৭৮৫টি কারখানায়, বিকেএমইএ-এর ১৩৮টি কারখানার মধ্যে ১১০টি, বিটিএমইএ-এর ১২২টির মধ্যে ১১১টিতে এবং অন্যান্য ৯৮২টির মধ্যে ৭৮০টি কারখানায় বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। তবে তিনি আরো বলেন, রবিবার ১৫/২০টি কারখানায় বেতন ভাতাসহ বিভিন্ন দাবিতে সমস্যা চলছে।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম জানান, বিজিএমই’র নির্দেশনা অনুযায়ী কারখানাগুলো আগামী ২ মে খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরকারিভাবে রপ্তানীমূখী কারখানার সিদ্ধান্ত নিলে গাজীপুরে কিছু কারখানা রবিবার খুলেছে। তবে করোনা সংক্রমনরোধে কারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে কি-না সেজন্য মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে।