গাজীপুরের শ্রীপুরে তিন সন্তানসহ ইন্দোনেশিয়ার বংশোদ্ভুত এক নারীকে কুপিয়ে ও গলা কেটে খুন করার ঘটনায় ৫জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-১’র সদস্যরা। এনিয়ে ওই চার খুনের ঘটনায় এপর্যন্ত ৬জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বুধবার র‌্যাব’র লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেঃ কর্ণেল সরোয়ার বিন কাশেম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

র‌্যাব’র হাতে গ্রেফতারকৃত ৫জন হলো- গাজীপুরের শ্রীপুর থানার আবদার গ্রামের মৃত আরসফ আলীর ছেলে রিক্সা চালক মোঃ কাজিম উদ্দিন (৫০), একই এলাকার মৃত আলাল উদ্দিনের ছেলে অটো রিকশা চালক মোঃ বশির (২৬), সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা থানার গাবি গ্রামের মৃত আব্দুল খালেকের ছেলে মোঃ হানিফ (৩২), একই জেলার দোয়ারা বাজার থানার কাঠালবাড়ী গ্রামের মোঃ আজিদ উল্লাহর ছেলে মোঃ এলাহি মিয়া (৩৫) ও ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার ফকিরপাড়া (আউয়াল নগর) গ্রামের মৃত হবি উদ্দিনের ছেলে ভাঙ্গারী বিক্রেতা মোঃ হেলাল (৩০)। গ্রেফতারকৃত হানিফ ও এলাহী পেশায় শ্রমিক। এর আগে গ্রেফতারকৃত কাজিম উদ্দিনের ছেলে পারভেজকে (১৭) গ্রেফতার করে পিবিআই। গত সোমবার আদালতে সে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দেয়। তারা সবাই এলাকায় মাদক সেবন, জুয়া, চুরি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত।

র‌্যাব’র লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেঃ কর্ণেল সরোয়ার বিন কাশেম জানান, গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের জৈনা বাজার কলেজ রোডের আবদার গ্রামের প্রবাসী রেজোয়ান হোসেন কাজলের দোতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলা থেকে ২৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় তার বড় মেয়ে সাবরিনা সুলতানা নূরা (১৬), ছোট মেয়ে হাওরিন হাওয়া (১২) ও বাক প্রতিবন্ধী ছেলে ফাদিল (৮) এবং ইন্দোনেশীয় বংশোদ্ভুত তার স্ত্রী স্মৃতি ফাতেমার (৪৫) গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। কাজল বর্তমানে মালয়েশিয়ায় কর্মরত আছেন এবং সেখানে অবস্থান করছেন। এ ঘটনায় কাজলের বাবা আবুল হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামীদের বিরুদ্ধে শ্রীপুর থানায় মামলা দায়ের করেন।

র‌্যাব’র ওই কর্মকর্তা জানান, শ্রীপুরের আবদার এলাকার প্রবাসী কাজলের স্ত্রী ও তিন সন্তানকে খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে শ্রীপুর উপজেলার আবদার এলাকা হতে ওই ৫জনকে আটক করে র‌্যাব’১এর সদস্যরা। মঙ্গলবার মধ্যরাত হতে বুধবার পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে আটক করা হয়। র‌্যাব’এর জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা ওই চার খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। পরে আটককৃতদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রক্তমাখা তাদের কাপড়, লুণ্ঠিত ৩০ হাজার টাকা ও স্বর্ণের আংটিসহ বিভিন্ন মালামাল উদ্ধার করেছে র‌্যাব সদস্যরা।

র‌্যাব’র জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা জানায়, কাজল মালয়েশিয়া থেকে হুন্ডির মাধ্যমে প্রায় ২০/২২ লাখ টাকা পাঠিয়েছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে কাজলের শ্রীপুরের বাসায় ডাকাতির পরিকল্পনা করে কাজিম ও হানিফ। পরে তারা আসামী বশির, হেলাল, এলাহিসহ অন্য আসামীদের সঙ্গে পরিকল্পনা চ’ড়ান্ত করে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় কাজিমের কিশোর ছেলে পারভেজ। তাদের আয়ের মাধ্যমে নেশা ও জুয়ার টাকা সংকুলান হচ্ছিল না বিধায় তারা এ অপরাধ সংগঠনে যুক্ত হয়।

গ্রেফতারকৃতরা জানায়, ডাকাতির পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ২৩ এপ্রিল রাত সাড়ে ১২টার দিকে প্রবাসী কাজলের বাড়ীর পিছনে তারা সবাই জড়ো হয়। পরে পারভেজ ভেন্টিলেটর দিয়ে হানিফ গাছ ও পাইপ বেয়ে ছাদে উঠে সিড়ির ঢাকনা খুলে বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করে। তারা বাড়ীর পিছনের ছোট গেট খুলে দিলে কাজিম, হেলাল, বশির, এলাহিসহ কয়েকজন বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করে। এরপর কাজিম এবং হেলালসহ তিনজন প্রথমে ফাতেমার ঘরে ঢুকে এবং কাজিমের হাতে থাকা ধারালো অস্ত্র দিয়ে ফাতেমা’কে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে বিদেশ থেকে পাঠানো টাকাগুলো দিতে বলে। ফাতেমা এত টাকা নেই বলে জানায়। পরে ফাতেমা তার রুমের স্টিলের শোকেসের উপর রাখা ৩০ হাজার টাকা তাদেরকে বের করে দেয়। পরবর্তীতে তারা ফাতেমার স্বর্ণালংকারগুলো ছিনিয়ে নেয় এবং পালাক্রমে ধর্ষণ করে। আসামী বশির ও এলাহিসহ আরও একজন ধারালো অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখিয়ে ভিকটিম নুরাকে পালাক্রমে ধর্ষণ ও গলার চেইনসহ তার স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেয়। এসময় ফাতেমার ছোট মেয়ে হাওয়ারিন’কে পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করে আসামী বশিরসহ আরও একজন। আসামী পারভেজও বর্ণিত হত্যাকান্ড এবং ধর্ষণে অংশগ্রহণ করে।

গ্রেফতারকৃত পারভেজ ২০১৮ সালে ৭বছরের শিশু নিলীমাকে ধর্ষণের পর গলা টিপে হত্যা মামলার চার্জশীট ভুক্ত আসামী। ওই মামলায় দীর্ঘ ৯ মাস জেল হাজত বাসের পর সম্প্রতি সে জামিনে মুক্তি পায়। মাস দেড়েক আগে ওই বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে খাটের নীচে লুকিয়েছিল পারভেজ। এসময় গৃহকর্ত্রীর হাতে ধরা পড়ে সে।

গ্রেফতারকৃতরা আরো জানায়, ডাকাতি ও ধর্ষণের এ ঘটনায় জড়িতদের চিনে ফেলে ফাতেমা ও তার মেয়েরা। তাই ফাতেমা ও তার তিন সন্তানকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে ও গলাকেটে মৃত্যু নিশ্চিত করে। তবে, সর্বশেষে প্রতিবন্ধী শিশু ফাদিলকে হত্যা করা নিয়ে আসামীদের ভিতর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তৈরী হয়। কিন্তু কোন প্রকার সাক্ষী না রাখার সিদ্ধান্তে প্রতিবন্ধী শিশু ফাদিলকেও হত্যা করা হয়। লুন্ঠনকৃত মালামাল ও টাকা কাজিম নিয়ে নেয় এবং সুবিধাজনক সময়ে পরস্পরকে বন্টন করবে বলে বাকীদের জানায়।

শ্রীপুর থানার ওসি লিয়াকত আলী জানান, ময়মনসিংহের পাগলা থানার লংগাইর ইউনিয়নের গোলবাড়ী গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে রেজোয়ান হোসেন কাজল প্রায় দেড়যুগ আগে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের জৈনা বাজার কলেজ রোডের আবদার গ্রামে দোতলা বাড়ি নির্মাণ করেন। এ বাড়িতেই তিনি স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে বসবাস করতেন। কাজল মিয়া বর্তমানে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন এবং চাকুরি করছেন। মালয়েশিয়ার আগে তিনি ইন্দোনেশিয়ায় প্রায় ১৬ বছর চাকুরি করেন। সেখানে থাকাকালীন কাজল মিয়া ওই দেশের নাগরিক স্ত্রী স্মৃতি ফাতেমা আক্তারকে প্রায় ২০ বছর আগে ভালবেসে বিয়ে করেন। বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে কাজল দেশে চলে আসেন। বৃহষ্পতিবার সন্ধ্যায় শ্রীপুরের বাড়ির দ্বিতীয় তলা থেকে কাজল মিয়ার স্ত্রী ও তিন সন্তানের গলা কাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।