গাজীপুরে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। বৃহষ্পতিবার সকাল পর্যন্ত জেলায় ৩৩২জন আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (ভূমি), পুলিশ, সাংবাদিক এবং শতাধিক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মী রয়েছেন। জেলার প্রায় অর্ধেক মিল কারখানা চালু হওয়ায় করোন সংক্রমনের ঝুকি মারাত্মক আকারে বেড়ে গেছে। এদিকে, গাজীপুরে করোনা ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহের জন্য জেলা ও সকল উপজেলায় একটি করে নিরাপদ বুথ স্থাপন করছে জেলা প্রশাসন।

গাজীপুর সিভিল সার্জন মো. খায়রুজ্জামান জানান, গাজীপুরের ৫টি উপজেলায় এপর্যন্ত (বৃহষ্পতিবার দুপুর) ৩৩২জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এরমধ্যে গাজীপুর সদর উপজেলায় সর্বাধিক সংখ্যক আক্রান্ত হয়েছেন। এ উপজেলায় আক্রান্ত হয়েছে ১১৪ জন। এরমধ্যে জেলার তেঁতুইবাড়িস্থ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মী রয়েছেন ৪০জন। অন্য উপজেলার আক্রান্তদের মধ্যে কালীগঞ্জে ৯১জন, কাপাসিয়ায় ৭০জন, কালিয়াকৈরে ৩৪জন ও শ্রীপুর উপজেলার ২৩জন রয়েছে। বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় শ্রীপুর উপজেলার একজনের দেহে করোনা ভাইরাস সনাক্ত হয়েছে। মঙ্গলবার ১৬৯জনের নমূনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় আইইডিসিআর-এ পাঠানো হলে বুধবার বিকেলে ১জনের পজেটিভ রিপোর্ট আসে। এদিন ’৭১ টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক ও তার ছেলের নমূনা পূনঃরায় পরীক্ষার প্রতিবেদনে নেগেটিভ আসে। ইতোপূর্বে ওই সাংবাদিক ও তার ছেলের নমূনা পরীক্ষায় করোনা ভাইরাস সনাক্ত হয়েছিল। বুধবার আরো ১২২ জনের নমূনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। এরমধ্যে কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ ৪২জনের নমূনা পূনঃ পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। ইতোপূর্বে তাদের নমূনা পরীক্ষার প্রতিবেদন পজেটিভ আসে।

তিনি আরো জানান, গাজীপুরের সরকারী বিভিন্ন হাসপাতালের ১২জন চিকিৎসক এবং ৫৭জন নার্স, মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্ট, হেলথ এসিস্ট্যান্ট, ল্যাবরেটোরি এসিস্ট্যান্ট ও ইপিআই টেকনোলোজিষ্টসহ স্বাস্থ্য বিভাগের মোট ৬৯জন এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়াও বেসরকারী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে বিশেষায়িত হাসপাতালের ৪০জন চিকিৎসক ও কর্মীর দেহে এ পর্যন্ত করোনা ভাইরাস সনাক্ত হয়েছে। এ ভাইরাসে জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (ভূমি), জিএমপি’র এসিসহ পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য, তিন সাংবাদিকও আক্রান্ত হয়েছেন। জেলায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে বৃহষ্পতিবার সকাল পর্যন্ত ১৬ জন সুস্থ্য হয়ে উঠেছেন। তবে মারা গেছেন দুইজন।

স্থানীয়রা জানান, নারায়নগঞ্জের পার্শ্ববর্তী গাজীপুরে করোনা ভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ হওয়ায় বিভিন্ন পেশাজীবীসহ স্থানীয়দের মাঝে আতংক দেখা দেয়। প্রশাসনের ঘোষিত লকডাউন মেনে অনেকে ঘরে অবস্থান নিলেও স্বল্প আয়ের মানুষরা তা মানছে না। আয় রুজির জন্য তারা আগের মতোই নিয়মিত রাস্তায় বের হচ্ছে। জেলার কারখানাগুলোর শ্রমিকরাও নিয়মিত তাদের কর্মস্থলে আসা যাওয়া করছে। ফলে জেলায় করোনা সংক্রমণের ঝুকি অব্যহত রয়েছে।

গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুশান্ত সরকার জানান, শিল্প-কারখানা অধ্যূষিত গাজীপুর জেলায় শ্রমিকসহ ২০ লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করে। তাই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গাজীপুর জেলাকে ইতোমধ্যে লকডাউন (অবরুদ্ধ) ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও গাজীপুরের প্রায় সবক’টি কারখানা ছুটি ঘোষণা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে কয়েকটি কারখানা জরুরী সেবার জন্য পিপিই, মাস্ক, ঔষধ, মানব খাদ্য, গো-খাদ্য উৎপাদন করতে চালু ছিল। কারখানা বন্ধ হওয়ায় বেশীরভাগ শ্রমিকই গ্রামের বাড়ী চলে যায়। গত রবিবার হতে গাজীপুর জেলায় দুই হাজার ৭২টি কারখানার মধ্যে প্রায় অর্ধেকগুলো কারখানা পর্যায়ক্রমে চালু হয়। এসব কারখানায় লক্ষাধিক শ্রমিক প্রতিদিন কাজ করছে। করোনা পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই এসব কারখানার শ্রমিকরা চাকুরি বাঁচাতে বাড়ি থেকে ঝুকি নিয়ে কর্মস্থলে ফিরে আসেন। প্রতিদিনই তারা লকডাউনের মধ্য দিয়ে বাসা থেকে কারখানায় আসা যাওয়া এবং কারখানায় পাশাপাশি কাজ করছে। এছাড়াও শ্রমিক ছাটাই ও বকেয়া বেতন-ভাতা না দেয়ার কারণে প্রায়শঃ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা করোনা সংক্রমন রোধে লকডাউন উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ ও আন্দোলন করছে। এসব ক্ষেত্রে তারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছেনা, মানছেনা করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধের নিয়ম নীতি। এতে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুকি মারাত্মক আকারে বেড়ে গেছে। তবে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধের নিয়ম নীতি কারখানাগুলোতে বাস্তবায়নের জন্য শিল্প পুলিশের পক্ষ থেকে কাজ করা হচ্ছে।

শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো. খলিলুর রহমান জানান, গাজীপুরের এ হাসপাতালে কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে যাত্রা শুরু হয়েছে গত বৃহষ্পতিবার হতে। এ হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ডেডিকেটেড এই হাসপাতালে স্থাপনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। এখানে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য এখানে ১০০শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে। এ হাসপাতালে চারটি ভেন্টিলেটর ছাড়াও ১০টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের আবাসন ব্যবস্থা শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেতরেই করা হয়েছে। এখানেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাতে তাদের এ হাসপাতাল ক্যাম্পাসের বাইরে যেতে না হয়।

তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিক্রমে গত ১৬এপ্রিল মন্ত্রণালয় থেকে ঢাকার তিনটি হাসপাতালের সঙ্গে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকেও কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়।

হাসপাতালের উপ-পরিচালক তপন কান্তি সরকার জানান, এখানে করোনা ভাইরাসের সংক্রমন পজেটিভ রোগীদের ভর্তি করা হচ্ছে। তাদের ফলো-আপ চিকিৎসার জন্য নমুনা পরীক্ষা করা হবে ঢাকার আইইডিসিআর-এ। যাদের লক্ষণ প্রকাশ পায়নি, কিন্তু করোনা সংক্রমন পজেটিভ, তারা বাসায় আইসোলেশনে থেকেও টেলিকমিউনিকেশনের মাধ্যমে এ হাসপাতালে কর্মরতবিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের জন্য পরামর্শ নিতে পারবেন। এখানে শুধু কোভিড-১৯ রোগীদের সিমটোমিক চিকিৎসা দেয়া হবে। যেমন- শ^াসকষ্ট, কাঁশি, জ¦র, ব্যথার মত রোগের চিকিৎসা দেয়া হবে। করোনা লক্ষণ নিয়ে আসা রোগীদের নমুনা সিভিল সার্জনের তত্ত্বাবধানে অন্যত্র পরীক্ষা করা হবে। এখানে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে না। এখানে আউটডোর তথা জরুরী বিভাগে এখন আর সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় না।

গাজীপুরে করোনা নমুনা সংগ্রহে ‘নিরাপদ বুথ’ স্থাপন
গাজীপুরে করোনা ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহের জন্য জেলা ও সকল উপজেলায় একটি করে নিরাপদ বুথ স্থাপন করছে জেলা প্রশাসন। গাজীপুর জেলা প্রশাসনের পরিকল্পনা ও অর্থায়নে নির্দিষ্ট ডিজাইনের পাঁচটি বুথ স্থাপন হয়েছে। করোনা ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহকারী ও নমুনা দাতার নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

কাপাসিয়া উপজেলার ইউএনও মোসা. ইসমত আরা জানান, কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ছাড়াও শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি এবং শ্রীপুর, কালিয়াকৈর, কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি করে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষা করার এসব বুথ স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় সংসদ সিমিন হোসেন ম্যাডামের আর্থিক সহায়তায় এছাড়া কাপাসিয়া উপজেলার প্রতিটি (১১টি) ইউনিয়নে এধরণের বুধ স্থাপন করা হয়েছে। এখানে ৩মে থেকে নমুনা সংগ্রহ শুরু করা হবে।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম জানান, ভারতের একটি মডেল ও ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মরতুজা এমপির এলাকায় ব্যবহৃত নমুনা অনুসরণ করে আমরা গাজীপুরে নিরাপদ বুথ স্থাপনের উদ্যোগ নেই। করোনার নমুনা যিনি সংগ্রহ করেন এবং যিনি দিতে যান দু’নের জন্যেই ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা একজন টেকনিশিয়ান পিপিই পড়েই নমুনা নিচ্ছেন। প্রথম নমুনা নেয়ার সময় সেই লোকটা যদি করোনা পজিটিভ হয় তবে তার জীবানুতে পিপিইটা আক্রান্ত হলো। পরে আবার অন্য একজন নরমাল মানুষের নমুনা সংগ্রহ করতে গেলে তিনি সেখান থেকে আক্রান্ত হয়ে যাবেন। এটা ভেবেই আমাদের মনে হলো-যে যিনি নমুনা নিচ্ছেন তাকে যেমন নিরাপদে রাখা দরকার তেমনি যার নমুনাটা নেওয়া হচ্ছে তাকেও নিরাপদ রাখা দরকার। এজন্যে নমুনা সংগ্রহ করার সময়, নমুনা সংগ্রহকারী বুথের ভিতরে গিয়ে দরজা জানালা আটকে দিবে। এসময় বাতাস পাওয়ার জন্যে বুথের ভিতরে একটি ফ্যান চালু থাকবে। আর যে নমুনা দিবেন তিনি বুথের বাইরে থাকবেন। এতে করে নমুনা সংগ্রহকারীকে নমুনা দিতে আসা ব্যক্তির সংস্পর্শে যেতে হবে না। নমুনা সংগ্রহরে সময় শুধু গ্লাভস পরিহিত হাতটা বাইরে যাবে। হাতে যে ফুল কোটেড গ্লাভসটা থাকবে সেটা নমুনা সংগ্রহের পর ফেলে দেবেন। নতুন কেউ আসলে আবার নতুন গ্লাভস পড়ে নমুনা নিবেন। ফলে কারোরই আর করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিও থাকবে না। যিনি গ্লাসের ভিতরে থেকে নমুনা নিচ্ছেন তিনিও নিরাপদ থাকবেন আর যার নমুনাটা নিচ্ছে তিনিও নিরাপদ থাকবেন। অর্থাৎ নিরাপদে নমুনা নিতে এবং দিতে পারার জন্যেই এ বুথ স্থাপন করা হচ্ছে। তাছাড়া নমুনা সংগ্রহকারীরর বারবার পিপিই পড়তে হবে না।