মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণে গত ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে সাধারণ ছুটিতে জনজীবন বিপর্যস্ত। নিম্ন আয়ের মানুষেরা রয়েছেন সরকারি ত্রাণ সাহায্যের অপেক্ষায়। আশা করছেন তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসবেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। এই দুঃসময়ে অনেকেই খোঁজ রাখছেন না অসহায় মানুষের। লকডাউনে যখন অনেক জনপ্রতিনিধি নিরাপদ থাকতে ঘরে থাকছেন, তখন ‘ব্যতিক্রমী’ দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র ইকরামুল হক টিটু।
ময়মনসিংহ জুবলি ঘাট এলাকায় থাকেন সুমন দাস। সেলুনে কাজ করেন তিনি। চলমান লকডাউন পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন কর্মহীন থেকে খাদ্য সংকটে পড়েছেন সুমন। লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ আনতে সংকোচ লাগে তার। একদিন তার বাড়িতে পৌঁছে যায় চাল, ডাল, তেল ও আলুভর্তি একটি বস্তা। জানতে পারেন, সিটি মেয়র ইকরামুল হক টিটু তার মতো মানুষের তালিকা তৈরি করে এভাবেই বাড়িতে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এমন অভিজ্ঞতা নগরীর অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের। প্রতিদিন মেয়র টিটু ছুটে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন ওয়ার্ডে। সরকারের ত্রাণ যোগ্য মানুষের হাতে পৌঁছাচ্ছে কি না তা সরেজমিনে তদারকি করছেন। এ পর্যন্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৪৩ হাজার ৫০০ প্যাকেট খাবার তিনি বিতরণ করেছেন। আর সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ থেকে দেওয়া হয়েছে ৬৯ হাজার প্যাকেট। প্রতি প্যাকেটে ছিল পাঁচ কেজি চাল, দুই কেজি ডাল ও দুই কেজি আলু। কিছু প্যাকেটে ছিল এক কেজি তেল ও সাবান। এ ছাড়া চার হাজার ৭৫৫ জনকে ৭১ লাখ ৩২ হাজার ৫০০ টাকা নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তবে অভাবী মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ায় কমপক্ষে আরও ২০ হাজার গরিব ও দুস্থ মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন তিনি।
মার্চের প্রথম সপ্তাহেই নগরীর আবাসিক, বস্তিসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সাড়ে ৪’শ পয়েন্টে হাত ধোঁয়ার ব্যবস্থা করেন মেয়র টিটু। এছাড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ৯৫ হাজার সাবান বিতরণসহ প্রায় ২০ হাজার হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও ২৫ হাজার মাস্ক বিতরণ করেছেন তিনি।
এছাড়া মেয়র টিটু নিজে উপস্থিত থেকে জীবাণুনাশক ও ব্লিচিং পাউডার মেশানো পানি দিয়ে নগরের প্রধান সড়ক এবং ওয়ার্ডগুলোর মূল সড়কসহ অলিগলি ধুয়ে পরিচ্ছন্ন রাখার উদ্যোগও নেন। নগরীতে উৎপাদিত বর্জ্য থেকে যেন করোনা না ছড়ায় সেজন্য নির্ধারিত ডাম্পিং স্টেশনে আগুন দিয়ে বর্জ্য পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
মেয়র ইকরামুল হক টিটু সকালে বাসা থেকে বের হয়ে যান সিটি করপোরেশনে। শেষ করেন দাপ্তরিক কাজ। এরপর শুরু করেন করোনাভাইরাস সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম। বিকেল থেকে শুরু হয় অসহায় মানুষদের খোঁজ খবর নেওয়া। কোথায় কেউ অভুক্ত থাকলে দেওয়া হয় ত্রাণ। এছাড়া ওয়ার্ডভিত্তিক ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলে রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত। রাতে বাসায় ফিরে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আবার বের হন। ছিন্নমূল মানুষদের মাঝে খাদ্য সহায়তা বিতরণ করে বাড়ি ফেরেন মধ্যরাতে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের ময়মনসিংহের আঞ্চলিক সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শিব্বির আহমেদ লিটন বলেন, সরকার ত্রাণ দিচ্ছে। অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ত্রাণ দিচ্ছেন। সমস্যা হচ্ছে, ত্রাণ দেওয়ার পদ্ধতি এখনো সেকেলে। তাই সঠিক ব্যক্তির হাতে সাহায্য পৌঁছানো নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, ‘তবে সিটি মেয়র তালিকা করার ক্ষেত্রে নিজে মাঠে থাকার কারণে এ ধরনের সমস্যা অনেক কম হচ্ছে। এখনো ত্রাণ নিয়ে কোনো অনিয়ম বা চুরির খবর পাওয়া যায়নি।’ ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ-সভাপতি শংকর সাহা বলেন, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের পাশেও থাকছেন মেয়র। পণ্যের বাজারমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করাসহ তাদের সমস্যাগুলোও নিজে থেকে সমাধান করছেন। ফলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের প্রয়োজন কম পড়ছে। মেয়র সরেজমিনে থেকে সমস্যাগুলো দেখে সমাধান করায় এটি সম্ভব হয়েছে।
মেয়র ইকরামুল হক টিটু বলেন, শুধু ফেসবুকে ছবি দিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ করে মানুষের প্রশংসা পাওয়া যায়। তবে খোঁজ নিয়ে যোগ্য লোকের হাতে বাজারের ব্যাগটি পৌঁছে দিতে না পারলে সেই প্রশংসার কোনো মূল্য থাকে না।
তিনি বলেন, যারা ভোট দেয়, তাদের মধ্যে অসহায় কারা- সেটি যদি ব্যক্তিগতভাবে জানাশোনা না থাকে, তাহলে একজন জনপ্রতিনিধির জন্য এর চেয়ে লজ্জার আর কিছুই হতে পারে না। যখন সুখে আছে তখন তাদের খোঁজ খবর রাখার দরকার মনে করি না। তবে তাদের দুঃখের সময় পাশে গিয়ে দাঁড়ানোটাই আমার কাজ। তাই ঘরে বসে থাকলে হবে না। নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই কাজ করার চেষ্টা করছি।
এদিকে মেয়র টিটুর সহধর্মিনী মিলা হক জানান, স্বামীকে নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কে থাকেন তিনি। এই মহামারির সময়ে অন্যদের মতো স্বামীকেও তিনি বাসায় রাখতে চান। তবে বাস্তবে তা সম্ভব না। মানুষের জন্য তাকে কাজ করতে হয়। তাই শঙ্কা থাকলেও তাকে বাইরে যেতে দিতে হয়।
নগরীর ১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসাদুজ্জামান বলেন, ত্রাণ সহায়তা গুছিয়ে দেওয়ার কারণে প্রকৃত অসহায় ব্যক্তিরা সাহায্য পাচ্ছেন। মেয়র সার্বক্ষণিক মাঠে থাকার কারণে এটি সম্ভব হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান সময়ের পেক্ষাপটে বাইরে বের হয়ে কাজ করতে আমার ভয় লাগে। তবে মেয়রের ত্রাণ বিতরণের ছবি দেখে মনে সাহস পাচ্ছি। তার গৃহীত পদক্ষেপের কারণে কাউন্সিলররা উৎসাহ পাচ্ছেন, তৎপর হচ্ছেন।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিতে দেশব্যাপী সরকারি ঘোষণার প্রায় এক সপ্তাহ আগেই নগরীর মেছুয়া বাজারকে ব্রহ্মপুত্র নদের বালুচরে স্থানান্তরিত করা হয়। এরপর থেকেই মেছুয়া বাজারে চাপ কমে। শহরের আটটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জীবাণুনাশক ট্যানেল স্থাপন করা হয়েছে। শহরের মেছুয়া বাজারের পাঁচটি প্রবেশমুখে একটি করে, নদীরপাড় কাঁচাবাজারে একটি, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও এস কে হাসপাতালে একটি করে ট্যানেল স্থাপন করা হয়েছে।
করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতার মধ্যে ও ডেঙ্গু দমনে পুরোদমে মশক নিধন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের স্যানিটারি ইন্সপেক্টর দীপক মজুমদার জানান, মেয়র ইকরামুল হক টিটুর নির্দেশে ৩৩টি ওয়ার্ডের জন্য ৪২টি ফগার মেশিনের মাধ্যমে অলি-গলিতে স্প্রে করা হচ্ছে। এজন্য প্রায় ৫০০ লিটার কীটনাশক সংশ্লিষ্টদের সরবরাহ করা হচ্ছে।