কথাটা কিভাবে শুরু করবে বুঝে ওঠতে পারছেনা আকাঙ্খা। খাবার টেবিলে বসে মায়ের দিকে একবার তাকায়। ইশারায় কথাটা বাবাকে বলতে বলে। মা সংশয় নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আকাঙ্খা, ওর বন্ধু বান্ধবরা মিলে কয়েকদিনের জন্য সিলেট,জাফলং যাবে সেজন্য কিছু টাকা চাইছিলো।’

আকাঙ্খার দিকে তাকিয়ে বাবা বললেন, ‘কত দিতে হবে?’

‘দশ হাজারের মত।’ আমতা আমতা করে বললো আকাঙ্খা।

‘কবে যাবি?’

‘এই তো ৪ দিন পর যাবো।’

বাবা নিচের দিকে তাকিয়ে খেতে খেতে বললেন, ‘তাহলে এক কাজ কর, ২ দিন দোকানে একটু সময় দে। আমি ২ দিনের জন্য এক জায়গায় যাবো। এসে তোর টাকাটা দেবো, হবে তো?’

‘আচ্ছা বাবা।’ মনে মনে বেজায় খুশি হলো আকাঙ্খা।

পরের দিন সকালে দোকানে গেলো সে। খুব বড় না হলেও মোটামুটি মাঝারি ধরণের একটা তৈরি পোষাকের দোকান তাদের। মাঝে মধ্যে আকাঙ্খা দোকানে এলেও সেভাবে কখনও দোকানে বসা হয়নি। আজকে প্রথম দোকানে বসলো। দোকানে তিনজন কর্মচারী রয়েছে। ওরা আকাঙ্খাকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছে। তার কাজ হলো কোন কাপড়ে কত টাকা লাভ হয়েছে সেটা লিখে রাখা আর মাঝে মাঝে কাস্টমারদের পোষাক দেখানো।

একজন কাস্টমারকে ২৫টার মত শার্ট দেখানোর পর কাস্টমারটা বললো, ‘না ভাই, পছন্দ হচ্ছেনা।’

আকাঙ্খা অবাক হয়ে বলে, ‘এত গুলোর শার্টের মাঝেও পছন্দ হয়নি?’

কাস্টমার বললেন, ‘না।’

মনটা খারাপ করে যখন শার্ট গুলো গুছিয়ে রাখছিলো তখন কর্মচারী এক ছেলে হেসে বললো, ‘ভাইয়া, মন খারাপ করে থাকলে হবেনা। সব সময় হাসি মুখে কাস্টমারের সাথে কথা বলতে হবে।’

কিছুক্ষণ পরে আরেকজন কাস্টমার এসে বললো, কিছু লেটেস্ট ডিজাইনের প্যান্ট দেখাতে। আকাঙ্খা দোকানের কিছু ভালো মডেলের প্যান্ট দেখালো। কাস্টমার ছেলেটি একটা প্যান্ট পছন্দ করলো। প্যান্টের ক্রয় মূল্য ছিলো ৯৫০ টাকা। আকাঙ্খা কাস্টমারের কাছে ১১৫০ টাকা চাইলো। ছেলেটা প্যান্ট উল্টে পাল্টে দেখে বললো, ‘৪০০ টাকা দিবেন?’

কাস্টমারের কাছে দাম শুনে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। দাঁতের সাথে দাঁত চেপে নিজের রাগটা নিজে কন্ট্রোল করে মুখে হাসি এনে বললো, ‘না, ভাইয়া, এত কম দামে এই প্যান্ট হবেনা।’

একটুপরে এক মহিলা কাস্টমার এসে ২ ঘন্টা ধরে দোকানের প্রায় সমস্ত কাপড় চোপড় উল্টে পাল্টে দেখে ২টা শাড়ি কাপড় পছন্দ করে বললো, ‘আমার স্বামী ২দিন পর বেতন পাবে তখন এই দুইটা কাপড়ের দাম দিয়ে গেলে হবে?’

রাগটা তখন সপ্তমে ওঠে গেলো। তারপরও কিছু বলতে পারছেনা আকাঙ্খা। কাস্টমার বলে কথা। রাগটা ছাই চাপা দিয়ে মুচকি হেসে বললো, ‘আন্টি, যেদিন আংকেল বেতন পাবেন সেদিন আংকেল কে নিয়ে না হয় শাড়ি নিয়ে যাবেন।’

এক উঠতি বয়সি ছেলে কাস্টমার সম্ভবত তার বান্ধবীকে সাথে নিয়ে দোকানে এসেছে। কর্মচারী ছেলেগুলো যে থ্রিপিস গুলোই দেখায় সেগুলো দেখে বলে আরো ভালো মানের কাপড় দেখাতে। অবশেষে কর্মচারী ছেলেটা বললো, ‘এর চেয়ে ভালো মানের কাপড় আমাদের দোকানে নেই।’

ছেলেটা মুখে একরাশ বিরক্তি এনে বললো, ‘দূর, শুধু শুধু এমন একটা ফকিন্নি দোকানে সময় নষ্ট করলাম!’

আর কত সহ্য করা যায়! আকাঙ্খা এবার বলে বসলো, ‘ভাই,আপনি বিশাল ধনি ঘরের ছেলে। এসব নরমাল জিনিস আপনার পছন্দ নয়, তাহলে যমুনা ফিউচার পার্ক, বসুন্ধরা
এই গুলো বাদ দিয়ে শুধু শুধু কেন এই সব সাধারণ শপিংমলে ঘুরাঘুরি করছেন?’

কাস্টমার ছেলেটার সাদা যখন কথা কাটাকাটি হচ্ছিলো তখন একজন কর্মচারী ছেলে ঐ কাস্টমার ছেলের কাছে মাফ চেয়ে বুঝিয়ে শুঝিয়ে বিদায় করলো। তারপর আকাঙ্ক্ষার দিকে চেয়ে বললো, ‘ভাইজান এমন করলে তো ব্যবসা হবে না। প্রতিদিন কত মানুষের কত রকম কথা শুনতে হবে। আপনি আজ প্রথম এসেছেন তাই অতশত বুঝছেন না।

দিন শেষে আকাঙ্খা হিসেব করে দেখে খরচ বাদ দিয়ে লাভ হয়েছে ৫০০ টাকা।

আকাঙ্খা দুই দিন দোকান দেখাশুনা করে। এই দুই দিনে আয় হয় ৩৪০০ টাকা! আর এই দুই দিনে যে পরিমাণ কষ্ট হয়েছে মনে হয় না আগে আকাঙ্খা জীবনে এত কষ্ট করেছে।

আকাঙ্খা অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। হাতে বেশ কিছুদিন সময়। এই অবসরে একটু জাফলং ঘুরে আসার পরিকল্পনা করেছে কয়েকজন বন্ধু মিলে। কোনও বাজে সঙ্গ বা বাজে কোনও অভ্যাস নেই আকাঙ্ক্ষার। বাজে কোনও ছেলের সাথে মিশেও না। পড়াশোনা এবং স্বভাব চরিত্র আচার ব্যবহারে ভাল গুটিকয়েক ছেলের সাথে একটু সখ্যতা আকাঙ্ক্ষার। বাজে সংসর্গ বা যা কিছু মন্দ তা বর্জন করে চলে প্রতিনিয়ত আর যা কিছু ভাল তা গ্রহন করে আকাঙ্খা। সত্য সুন্দর এবং আলোকিত পথেই চলতে চেষ্টা করে সর্বদা। সর্বপরি একজন মানুষের মত মানুষ হওয়ার চেষ্টা।

রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে ড্রয়িং রুমে বসে টিভি অন করে আকাঙ্খা। এমন সময় বাবা এসে বললেন, ‘এইযে নে তোর ১০ হাজার টাকা।’

আকাঙ্খা বাবার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কিসের টাকা?’

বাবা বিস্ময় কণ্ঠে বলেন, ‘তুই না জাফলং যাবি বন্ধুদের সাথে?’

বাবার দিকে তাকিয়ে আকাঙ্খা বললো, ‘বাবা আমি আগে জানতামই না টাকা ইনকাম করতে কতটা কষ্ট হয় তাই তোমার কাছে কত কিছু আবদার করতাম। আমি এই দুই দিনে খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছি টাকা ইনকাম করার কি কষ্ট। যে আমি ২ দিনে ৪ হাজার টাকাও ইনকাম করতে পারলাম না সেই আমি ১০ হাজার টাকা কিভাবে আবদার করি। এত টাকা খরচ করা আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য অপচয় বাদে কিছুই নয় বাবা।’

কথাগুলো শুনে বাবা কিছুটা রাগি গলায় বললেন, ‘এত পাকামী কথা বলতে হবেনা। বন্ধুরা সবাই যাচ্ছে তুইও যা। জাফলংএর পাহাড় আর আকাশের বিশালতা দেখলে তোর খুব ভালো লাগবে।’

বাবার হাত ধরে আকাঙ্খা বললো, ‘পাহাড় কিম্বা আকাশের বিশালতা দেখতে জাফলং বা সমুদ্রে যেতে হয় না। বাবার চোখের দিকে তাকালেই বিশালতা দেখা যায়। যে বাবারা হাজার কষ্টেও সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে চেষ্টা করেন সেই বাবাদের স্যালুট। আল্লাহ সকল বাবা মায়েদের সুস্থ রাখুন, ভাল রাখুন। বাবা মানে শুধু বাবা নয়, বাবা মানে বটবৃক্ষ ; বাবা মানে মাথার ওপর ছাদ। বাবা মা না থাকলে আজ আমার আশ্রয় হতো এতিমখানায় বা ফুটপাতে। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া আমার মা আছেন, আমার বাবা আছেন। আমি যেন বাবা মায়ের মূল্যায়ন করে চলতে পারি আল্লাহ আমাকে সেই ক্ষমতা দান করুন আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা।’

একটুক্ষণ নিরব থাকার পরে আকাঙ্খা আবার বললো, ‘বাবা, দোকানে তিন জন কর্মচারী রাখার কোন দরকার নেই। আজ থেকে আমি দোকানে বসবো।’

বাবা কোন উত্তর না দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে বললেন, ‘দূর, চোখে যে পড়লো!’

আকাঙ্খা বুঝতে পারে চোখে কিছু পড়েনি। বাবা চোখের জল লুকোনোর জন্যে মিথ্যা বলছেন।

আসলে বাবা মায়েরা এমনই ; কখনো নিজেদের কষ্ট সন্তানদের বুঝতে দেন না।

– রুদ্র অয়ন
ঢাকা, বাংলাদেশ