ইজি চেয়ারে বসে সারাদিনের ঘুষের উপার্জন গুনছেন নাদের বাবু। কেউ দিয়ে গেছে পাঁচশো টাকার বান্ডিল, কেউ দিয়ে গেছে এক হাজার টাকার বান্ডিল। উল্টো পাল্টা নোট গুলো গুছাতে গুছাতে মনে মনে গালি দিতে থাকলেন সেই টাকা যারা দিয়েছে তাদের।

মনে মনে নাদের বাবু বলছেন -শালা মানুষ গুলো ভাল মতো টাকা গুলো গুছিয়েও দিতে পারেনা। ওরা জানেনা যে এখন ব্যাংকে উল্টা পাল্টা টাকা নেয় না! কাউন্টারে ভেটকি মেয়েটা প্রতিদিন ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ করে উল্টা পাল্টা টাকা দেখলে!

নিজের মনে মনে টাকা গুলো আবার গুনতে শুরু করবেন এমন সময় ঘড়িতে ঢং ঢং করে পাঁচটা বাজার সংকেত দিল। দেয়ালে একটা পুরানো আমলের ঘড়ি লাগানো নাদের বাবুর অফিসে। শিক্ষা অফিসে আজ প্রায় ৭ বছর হতে চলল নাদের বাবুর। এখানে ঢোকার সময় পুরো দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে নেতা কে খুশি করে তারপর নেতার সেক্রেটারিকে দুই মাসের বেতনের সমান টাকা দিয়ে তারপর চাকরি টা পেয়েছেন তিনি। এজন্য নাদের বাবুর সকল জমিজমা বন্ধক দিতে হয়েছিলো। আর এখানে চাকরি পেয়েই প্রথম মাস থেকে শুরু করেছেন পুরো দমে ঘুষ খাওয়া। পুরো বারো লাখ টাকা দিয়ে নাদের বাবুর বাপের আমলের জমি ছাড়াতে পাঁচ বছর লেগে গেছে। বাবা মারা গেছেন আগেই, ইতোমধ্যে তার মাও মারা গেছেন। নাদের বাবু বিয়ে করেছেন । মেয়ে ও আছে একটা।

ক্লাশ টু তে পড়ে।
আজ নাদের বাবুর মন খুব ভাল। কারণ আজ প্রথম বার নিজের জন্য ঘুষ খেয়েছেন তিনি। এর আগে জমি ফেরত পেতে আর নতুন ফ্লাট কেনার জন্য খেয়েছেন। চিন্তা করেছিলেন ছেড়ে দেবেন ঘুষ খাওয়া। কিন্তু কিছুই করার নেই। অভ্যাস হয়ে গেছে। ঘুষ ছাড়া একটা ফাইল ও ছাড়েন না তিনি। পাঁচশো টাকার বান্ডিল টা গোনা প্রায় শেষ এমন সময় পিয়োন এসে বলল- ‘স্যার এক জন বুড়া লোক একটা ফাইল নিয়ে এসেছে। অনেক বার বলেছি আজ অফিস শেষ
কিন্তু ব্যাটা কিছুতেই শুনছেনা! স্যার, তাকে কি আসতে বলবো?’
ফাইলের কথা শুনে নাদের বাবুর চোখ দুটো চকচক করে উঠলো !
বললেন- ভেতরে পাঠিয়ে দে। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে নেই রে।’
নাদের বাবুর কথা শুনেই পিয়োন দৌড় দিল বুড়োকে আনতে। নাদের বাবু তাড়াতাড়ি সামনে পড়ে থাকা নোট গুলো পাশে পড়ে থাকা কালো ব্যাগে ভরে একটা ভারিক্কি চাল নিয়ে বসে থাকলেন।
খদ্দেরের সামনে হাসি মুখ নিয়ে থাকলে আবার কেউ টাকা দিতে চায়না। টাকা দিতে গড়িমসি করে। টাকা নিয়ে কি কি করবেন কি কি কিনবেন এটা চিন্তা করতে করতে সুখে প্রায় চোখ বুজে ফেলেছিলেন নাদের বাবু।
এমন সময় খুঁক করে কাশি শুনে সামনে তাকালেন তিনি- তাকিয়ে পুরো থ’ মেরে গেলেন। দেখেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো!

কারণ সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তার স্কুলের ইদু স্যারের । স্যারের সাহায্য ছাড়া কোন ভাবেই সরকারী স্কুলে চান্স পেতেন না নাদের বাবু। স্যারকে দেখেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার! অবশ্য মনে মনে ভাবছেন এতদিন পর স্যার হয়তো চিনবেন না। চেহারা ও শারিরিক গঠণেতো অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এর মাঝে নাদের বাবুর বিশাল এক ভূড়ি হয়ে বসেছে । চেহারাও গোলগাল, গোপাল গোপাল টাইপের হয়েছে।

কিন্তু নাদের বাবুকে পুরো অবাক করে দিয়ে স্যার বলে ওঠলেন-
‘আরে নাদের তুই ? কেমন আছিস? আমাকে চিনেছিস? আমি তোর সেই স্কুলের ইদু স্যার! আমাকে অনেক গুলো অফিসে ঘুরিয়ে তোদের সেকেন্ড অফিসার আমাকে বলেছে তোর কাছে আসতে। আমাকে আরও বললো তুই নাকি ঘুষ খাস! যেন বেশ কিছু টাকা নিয়ে দেখা করি। আমি ভাবলাম আগে দেখা করি। তারপর যা হয় দেখা যাবে।’
নাদের বাবু মনে মনে গালি দিতে দিতে মুখে বললেন – ‘হ্যাঁ স্যার, কেমন আছেন? বসুন, বসুন। বলুন কি করতে পারি?’
এবার ইদু স্যার খুব কষ্ট পেলেন। নাদের তার প্রিয় ছাত্রদের মাঝে অন্যতম ছিলো। আর আজ কিনা ওঠে দাঁড়িয়ে সম্মান পর্যন্ত দেখাল না!
আস্তে আস্তে ফাইলটা সামনে রেখে বসলেন ইদু স্যার । কষ্ট পেলেও মুখের ভাব ঠিক রেখে বললেন- ‘বাবা, দেখো না এই ফাইলটা আমার পেনশনের ইনক্রিমেন্ট বাড়ানোর ব্যাপারে একটা সাইন লাগবে। সামনের মাসে আমার মেয়ে রেখা’র বিয়ে। খুব সংকটের মধ্যে আছি। ‘
চোখ মুখ শক্ত করে বসে ছিলেন নাদের বাবু। সামনে ফাইলটা নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখলেন। একটু মনে মনে গুনে নিলেন কত টাকা খেতে পারবেন। ভেবেই ফাইলটা বন্ধ
করে ডানে পাশে রেখে বললেন -‘হুম বুঝেছি- এটার জন্য আপনাকে দুই মাস পড়ে আসতে হবে।’
কখা শুনে অবাক হয়ে গেলেন ইদু স্যার! ভ্রু বাকিয়ে বললেন- ‘মাত্র একটা সই বাকি আছে রে! এটা করতেই দুইমাস?’
‘আহা বুঝছেন না কেন? দেখছেন না চারদিকে কত ফাইল! এখানে সিরিয়াল বলে একটা ব্যাপার আছে। আর আমার তো কাজের অভাব নেই। এত কাজের মাঝে কত ফাইল আসবে। তাই কমসে কম দুইমাস লাগবে।’ বলেই ব্যাগ গুছাতে শুরু করে দিলেন নাদের বাবু। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন ইদু স্যার! নাদের কি থেকে কি হয়ে গেল! কোন ভাবেই নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছেন না! তিনি অনেক কষ্টে বললেন- ‘বাবা নাদের তোমাকে কি ঘুষ দিতে হবে?’
উত্তরে নাদের বাবু যা বললেন তাতে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল ইদু স্যারের!
নাদের বাবু বললেন- ‘দেখুন, এখান থেকে ফাইল সাইন করিয়ে নিয়ে যেতে দুটো বান্ডিলে ৫০০ টাকার ১০০ টা নোট লাগে। আসলে এটা হলো উপহার। এটাকে ঘুষ বলবেন না। আমাকে আপনি কিছু দেবেন, আমিও আপনাকে কিছু দেব।’
একটুক্ষণ নিরব থেকে পরক্ষণে আবার নাদের বাবু বললেন – ‘আপনি আমার পরিচিত। তাই আপনার জন্য কনসেশন আছে। আপনি ৫০০ টাকার ৫০ টা নোট দিলেই হবে। আপনার ফাইল এ সাইন হয়ে যাবে।’ বলেই খট খট করে হেসে উঠলেন নাদের বাবু।
ইদু স্যারের বুকের ভেতর কেমন যেন ব্যথা করে ওঠলো। নিজেকে সামলে নিয়ে পলিথিনের ব্যাগ থেকে টাকা বের করলেন তিনি। টাকা দিতে হবে ভেবেই সাথে এনেছিলেন। কিন্তু তাঁর আদর্শ এভাবে বলিদান হবে তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। ফাইলে সই করিয়ে ইদু স্যার চলে গেলেন। যাবার সময় কাঁদো কাঁদো চোখে তাকিয়ে ছিলেন নাদের বাবুর দিকে। নাদের বাবু তখন টাকা গণনায় ব্যস্ত ।