করোনা আক্রান্ত গোটা বিশ্ব। সেই সাথে আমার দেশ ও। দিন দিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা সেই সঙ্গে মৃতের সংখ্যা ও । বিভিন্ন সরকারি তেমনি বেসরকারি হাসপাতালগুলো বিশেষায়িত হচ্ছে শুধু করোনা আক্রান্ত অথবা সন্দেহভাজন রোগীর চিকিৎসা সেবার জন্য।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও তেমনি করোনা রোগীদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করা হল। আমরা মানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডাক্তাররা বেশ আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম মানুষিক ভাবে , এই চিকিৎসা সেবায় যোগ দেবার জন্য। যদিও ঘোষণা করার অনেক আগের থেকেই আমরা করোনা রোগী নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছিলাম। বিশেষায়িত হাসপাতাল ঘোষণা করার পর এই কাজে একটা সমন্বয় এলো।

একসময় আমারও ডাক পড়লো এই কাজে যোগ দেবার জন্য। যদিও আমার বিভাগের অর্থাৎ ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালের থোরাসিক সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার, মেডিকেল অফিসার ইতিমধ্যেই যুক্ত হয়েছে এই কাজে।

সাত দিন ডিউটি, তারপর চৌদ্দ দিন সঙ্গনিরোধ। অর্থাৎ quarantine। হোটেল নির্ধারণ করা হল। দিন ক্ষণ ও ঠিক হল। করোনা রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রায় বিভিন্ন পরিচিত অপরিচিত কাছের দূরের অনেকের ফোন পেতাম , করোনা রোগ বিষয়ে, ঢাকা মেডিকেল এ ভর্তি তাদের করোনা রোগীর খোজ খবর নেবার জন্য। আর আমি সরাসরি তাতে যুক্ত হবার পর এটা আরো বাড়লো।

মানুষিক প্রস্তুতি আগেই নেয়া ছিল। ভয় ছিল না। তবে একটা মনের চাপ ছিল। নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করে রোগীর সেবা নিশ্চিত করার। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু চিকিৎসক আক্রান্ত অবস্থায় হোটেলে এ আছেন।

হাসপাতালের ডিউটি সব দিনগুলোই ছিল অনেকটই একরকম । প্রায় পাঁচ বছরের চেনা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল যেনো আমার কাছে এখন নতুন কিছু। সুরক্ষা সামগ্রী পরিহিত ডাক্তার, নার্স আর বাকি স্বাস্থ্য কর্মী। এই সুরক্ষা পোশাক বা পি পি ই পরে লম্বা সময় কাজ করতে হয়। সে এটা মোটেই সুখকর অভিজ্ঞতা না।

তবে প্রথম দিন প্রায় 250 রোগী রাউন্ড দিলাম বিভিন্ন ফ্লোরে গিয়ে। একসময় বেশ কিছুটা শ্বাস কষ্ট হচ্ছিল এই মাস্কের জন্য। আমি মাস্কের ভিতরেই মুখ হা করে শ্বাস নিচ্ছিলাম। তাতেও যেনো বুকে বাতাস যাচ্ছিলনা ।

আমার এমনিতেই অনেক ঘাম হয়। আর সেটা গরমের সময় তো কথাই নেই। তার উপর আবার এই পোশাক। যা ভেদ করে কিছুই ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। হোটেল থেকেই সেটা আমি পড়ে বের হতাম। সারা শরীর আবৃত। মাথা থেকে একদম পা পর্যন্ত। আর মুখ ঢাকা তিন টা মাস্ক। মাস্কের চারপাশ টেপ দিয়ে মুখে ভালোকরে আটকিয়ে রাখা। যেনো বাতাস মাস্ক ব্যতীত অন্য কোনো ফাঁক ফোকর গলে শরীরে না প্রবেশ করে। কারণ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে অদৃশ্য শত্রু। হাতে দু স্তরের গ্লাভস। এমনকি পায়ের জুতা পুরো ঢাকা। চেহারা ঢাকা গগলস আর ফেস শিল্ড দিয়ে।

ডিউটি করার পুরো সময় এটা পরে থাকতে হবে। কোনো ভাবেই খোলা যাবে না। প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেবার বা একটু পানি পানের ও সুযোগ নেই। এটা পরে কাজের অভিজ্ঞতা শুধুই যারা পড়েছে তারা টের পেয়েছে। লিখে বুঝিয়ে বলা যাবে না ।

আর কাজ এর ফাঁকে রুমে এসে বসলে যখন রুমের ফ্যান ছাড়তাম সেটা আসলে শুধুই সেটা চোখে দেখে শান্তি পেতাম। বাতাস অনুভবের কোনোই সুযোগ ছিলনা। পিপিই ভেদ করে বাতাস আর টের পাওয়া যাচ্ছে না।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এর প্রথমে বার্ন ইউনিট পরে হাসপাতালের নতুন ভবনে করোনা রোগী এবং সন্দেহভাজন করোনা রোগী ভর্তি করা হয়। তাদের মেডিসিন, সার্জারি এবং গাইনী এই তিনটি মূল ভাগে প্রয়োজন অনুযায়ী চিহ্নিত করে চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছিল।

রোগীদের সঙ্গে রোগীর সেবাদানকারী অনেক স্বজন আক্রান্ত একই সাথে। তারা এরপরেও পরম মমতায় আর ভালোবাসা দিয়ে রোগীর পরিচর্যা করছেন। অনেক ডাক্তার ও ছিলেন রোগী হিসেবে ভর্তি অবস্থায়। কোনো ক্ষেত্রে রোগীর পরিচর্যাকারী ছিলেন ডাক্তার। রোগীদের মাঝে সব শ্রেণী পেশার মানুষ ছিল। ছিল রাজনীতিক, চিকিৎসক, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আবার তেমনি একেবারেই সাধারণ মানুষ ও।

আমি এই করোনা যুদ্ধে অনেক রোগীকে যেমন জিততে দেখেছি। ঠিক তেমনি ভাবে পরাজয় মেনে নিয়ে চির নিদ্রায় শায়িত হতেও দেখেছি অনেককে। একটু শ্বাস নেবার প্রবল আকুতি তাদের চেহারায়। পৃথিবী ভর্তি বাতাস কিন্তু তাদের ফুসফুস এরপরে ও বাতাসের জন্য হাহাকার করছে। রোগীদের চোখ ঠিকরে বের হতে চায়। আর এই দৃশ্য দেখে তাদের স্বজনরা চোখের পানি ফেলছে। রোগী ভর্তি শ পাঁচেক। আইসিইউ শয্যা সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ। অনেকের দরকার একটু আইসিইউ সাপোর্ট। কিন্তু সেটা করার সুযোগ কই। আমরা অসহায়ের মত অনেকসময় আত্মসমর্পণ করি। যারা আইসিইউ তে চিকিৎসাধীন তাদের সরিয়ে আরেকটা রোগী ভর্তি করা যায়না।

তবে তাই বলে সব রোগী এই অবস্থায় নেই মোটেই। অধিকাংশ রোগী চিকিৎসায় ভালো হচ্ছে , ভালো হচ্ছে তাদের প্রচন্ড মনের শক্তি নিয়ে।

খুব ভালোলাগার দৃশ্য ছিল সেসব রোগীর চোখে মুখে যারা করোনা সন্দেহে ভর্তি হয় কিন্তু পরীক্ষায় করোনা পাওয়া যায়নি। তারা দ্রুত হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ী যাবার জন্য উন্মুখ।

চিকিৎসক হিসেবে রোগী সুস্থ হওয়া যেমন দেখেছি, তেমনি রোগের কাছে জীবনের পরাজয় ও দেখেছি। এটা চেনা দৃশ্য সকল চিকিৎসকের কাছে। কিন্তু এই করোনা সংকটে এটার অভিজ্ঞতা ভিন্ন রূপ ধারণ করে। আমরাও রোগীদের সাথে সমান ভাবে আবেগ তাড়িত হই।

আমার ডিউটি চলাকালীন অধ্যাপক গোলাম কিবরিয়া স্যার ভর্তি হন। উনি দেশের প্রথিতযশা এবং একই সঙ্গে পাইওনিয়ার ইউরোলজি সার্জন। দুর্ভাগ্য বশত ভর্তির মাত্র দুই দিন পর উনি মৃত্যুবরণ করেন। সারাদেশেই বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসক মৃত্যুর খবর যেনো বেড়েই চলছে। সেই সাথে বাড়ছে তাদের আক্রান্তের সংখ্যা।

প্রায় প্রতিদিন ফোন পাই রোগী ভর্তি করা নিয়ে। সব থেকে বেশি ফোন পেতাম আইসিইউ তে ভর্তি করার জন্য। আর দিব থেকে অসহায় ও বোধ করতাম তখন।

ফেসবুক বা বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে বা নানা মিডিয়ায় যে সব ওষুধ খাবার পরামর্শ মানুষ পাচ্ছিল অনেক রোগী সেসব খেয়েও শেষ রক্ষা করতে পারে নি।

তবে সকল চিকিৎসক ,নার্স আর স্বাস্থ্য কর্মী নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন রোগীদের জন্য। সরকারি ওষুধ সাপ্লাই আছে। করোনা সময়ে বিদেশ যাত্রা বন্ধ। যেসব রোগী অল্পেই বিদেশি চিকিৎসক নির্ভর ছিলেন তাদের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দেশীয় চিকিৎসকের কাছেই আসতে হচ্ছে। আর আমি জানি তারা নিরাশ হন নি। তাদের এই আস্থা রাখার জন্য তাদের ধন্যবাদ দেই। এবং ভবিষ্যতেও অন্য রোগের ক্ষেত্রেও এই আস্থা রাখতে অনুরোধ করছি।

মনে রাখতে হবে চিকিৎসকরা শুধুই চিকিৎসা দিতে পারবেন। হাসপাতালের অন্যান্য সেবা সুযোগ সুবিধা, চাহিদা, বেড বাড়ানো , আইসিইউ ব্যাবস্থা এসবের কোনোটাই চিকিৎসক এর ক্ষমতা ভুক্ত না।

বহু চিকিৎসক কিন্তু আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের অনেকেরই আইসিইউ তে থাকার মত অবস্থাও হচ্ছে। কিন্তু কোনো সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল এমনকি তাদের নিজের কর্মস্থলের হাসপাতালেও তাদের জন্য কোনো বিছানা বা আইসিইউ বরাদ্দ নেই। অন্য রোগীদের মত তারাও একই কাতারে চিকিৎসা নিচ্ছে। যদিও তাদের অগ্রাধিকার পাওয়া অধিকার আছে। (পুলিশের সদস্য আক্রান্ত হলে তাদের নিজস্ব হাসপাতাল আছে)।

এরপরেও থেমে নেই আমাদের কাজ। আমরা আছি রোগীদের পাশে, রোগীদের সেবায়। সর্বক্ষণ। এই লড়াই আমাদের সবার সুস্থ হবার লড়াই, জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আমাদের জয় হবেই, সেটা আজ না হয় কাল।”

 

সেরাজুস সালেকিন।
বক্ষ ব্যাধি সার্জন থোরাসিক সার্জারি বিভাগ
সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হসপিটাল।