গাজীপুরে গ্রেফতারকৃত মোখলেছ আলীকে ২০ মাসেও কারামুক্ত করতে পারে নি তার পরিবার। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি কারাগারে বন্ধি থাকায় তার স্ত্রী ও অসুস্থ্য বৃদ্ধ মা বাড়ী বাড়ী ভিক্ষা করে দিন কাটাচ্ছেন। মৃত্যুর আগে ছেলেকে কোলে ফিরে পাওয়ার শেষ ইচ্ছা জানিয়ে বৃদ্ধ মা কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন। মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করে কে মোছাবে চোখের পানি। এ ব্যাপারে অসহায় পরিবারটি সশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

এলাকাবাসি জানান, নাটোরের বাঘাটিপাড়া থানার নওপাড়া এলাকার মৃত সাহেব আলীর ৬ ছেলে ও ৩ মেয়ের মধ্যে সবার ছোট মোখলেছ আলী (৩২)। অভাব অনটনের সংসারে বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও একমাত্র সন্তান এবং প্রতিবন্ধি ভাইকে নিয়ে একটি ছনের ছোট ঘরে বসবাস করেন তিনি। মা মাজেদা বেগম (৮০) এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে ঝিয়ের কাজ আর তার ছেলে মোখলেছ এলাকায় দিন মজুরের কাজ করতেন। মা ও ছেলের আয়ে খেয়ে না খেয়ে কোনমতে চলছিল তাদের দিন। একপর্যায়ে বার্ধক্য জনিত কারণে মাজেদা বেগম কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। ফলে পাঁচ সদস্যের এ পরিবারটি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে মোখলেছের আয়ের উপর। পরিবারের খরচ যোগাতে মোখলেছ দিশেহারা হয়ে পড়েন। অর্থাভাবে বৃদ্ধ মা ও প্রতিবন্ধি ভাইয়ের ঔষধ ও পরিবারের খাবার জোটানো মোখলেছের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছিল। দিনমজুরী করে যা অর্থ উপার্যন করেন তা দিয়ে সংসার চলছিল না। ফলে অর্থাভাবে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছিলেন তারা। পাশাপাশি এলাকাবাসীর কাছ থেকে সাহায্য সহযোগীতা ও ঋণ নিয়ে পরিবারের খরচ জোটাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন মোখলেছ। তাদের পরিবারের অভাব অনটন ও দুর্দশা দেখে পার্শ্ববর্তী বড়াইগ্রাম থানার চরনোটাবাড়ীয়া এলাকার আসকান সরদারের ছেলে রসুল সরদার (৩৩) সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেন। নাটোর-ঢাকা রুটের যাত্রীবাহী একটি বাসের চালক তিনি। মোখলেছকে তার বাসের কন্ডাক্টর (সুপারভাইজার) হিসেবে কাজ পাইয়ে দেন ড্রাইভার রসুল সরদার। বাসে চাকুরি করে সামান্য যা টাকা উপার্জন করেন তা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের মুখে দু’মুঠো খাবার জোটাচ্ছিলেন মোখলেছ। ডিউটি শেষে বাড়ি ফিরে মা, স্ত্রী, সন্তান ও ভাইকে নিয়ে একত্রে খেতে বসতেন তিনি। এভাবেই চলছিল তাদের দিন।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত ২০১৮ সালের ১ নবেম্বর বাসটি নাটোর থেকে যাত্রী নিয়ে ঢাকা যাচ্ছিল। রসুল সরদার বাসটি চালাচ্ছিলেন, আর মোখলেছ বাসের কন্ডাক্টরের দায়িত্ব এবং নাটোরের বাঘাটিপাড়া থানার নওপাড়া এলাকার বাসেদ আলীর ছেলে সেলিম আলী (৩৪) হেলপারের দায়িত্ব পালন করছিলেন। বিকেলে বাসটি গাজীপুরে কালিয়াকৈরের চন্দ্রা এলাকায় পৌঁছে। মোখলেছের ভাই জানান, বাসের ভিতরে কে বা কারা হিরোইন রেখে যায়। এসময় র‌্যাব-১’র সদস্যরা বাসটির গতিরোধ করে অভিযান চালায়। তারা বাসটিতে তল্লাশিকালে যাত্রীদের সিটের উপরের সেলফ থেকে সাড়ে ৫শ’ গ্রাম হেরোইন ভর্তি ৫টি প্যাকেট (প্রতি পলি প্যাকেটে ১১০গ্রাম করে) উদ্ধার করে। হেরোইন পাচারের এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে র‌্যাব সদস্যরা মোখলেছ, রসুল সরদার ও সেলিম আলীকে আটক করে। তাদের কাছ থেকে নগদ টাকা ও মোবাইল ফোনও জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় পরদিন মাদকদ্রব্য আইনে কালিয়াকৈর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের আদালতে পাঠানো হলে বিচারক তাদের জামিন না মঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরণ করেন। গাজীপুর কারাগারে দেখা করতে গেলে মোখলেছ তার ভাই মোফাজ্জলকে জানায় হেরোইনের প্যাকেট বাসে কিভাবে এসেছে তা আমরা কেউই জানি না। হতে পারে কোন যাত্রী এটা বহন করছিল র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে সে সটকে পড়েছে। মোখলেছ এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত দাবী করে তাকে মুক্তির ফরিয়াদ জানায়।

মোখলেছের ভাই মোফাজ্জলসহ স্বজনরা জানান, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মোখলেছ প্রায় ২০ মাসেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে বন্দি রয়েছেন। তার অনুপস্থিতিতে পরিবারের হাল ধরার মতো কেউ নেই। এদিকে মোখলেছের অন্য ভাইবোনেরাও অর্থকষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। মোখলেছকে ছাড়িয়ে আনতে ও মামলার খরচ চালাতে টাকার প্রয়োজন। কিন্তু টাকার অভাবে পরিবারের পক্ষ থেকে আদালতে আইনজীবী নিয়োগ করতে পারছেন না তারা। ফলে আদালতে জামিন না পেয়ে মোখলেছ মাসের পর মাস কারাগারে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। অপরদিকে উপায়ান্তর না পেয়ে মুখে খাবার জোটাতে মোখলেছের বৃদ্ধ মা ও স্ত্রী এলাকায় মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করছেন আর চোখের পানি মুছছেন। কারাবন্ধি মোখলেছকে মুক্ত করে অসহায় বৃদ্ধ মায়ের চোখের পানি মোছাতে স্বজনরা ধর্ণা দিচ্ছেন বিভিন্ন মহলের কাছে।

মোখলেছ খুবই দরিদ্র পরিবারের ছেলে। সে একাই সংসারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দীর্ঘ ২০ মাস বিনা বিচারে আটক থাকায় তার পরিবার চরম অর্থকষ্টে পড়েছে। উপায় না পেয়ে তার মা ভিক্ষা করতে নেমেছেন বাড়ী বাড়ী। চরম অসুস্থ্য মা ছেলের চিন্তায় আরও অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন। এলাকায় যাকে পাচ্ছেন তার হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করছে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য। এখন তার একটাই ভয় ছেলেকে না দেখেই হয়তো রাস্তায় পড়ে মারা যাবেন তিনি। এক সাংবাদিকের হাত-পা ধরে কাকুতি মিনতি করে তিনি বলেন, বিচার কর, বিচারে আমার ছেলে নির্দোষ হলে তাকে আমার কাছে আমার মৃত্যুর আগে ফিরিযে দাও। আমি আমার ছেলেকে দেখে মরতে চাই।