বিস্তর অভিযোগের পরও বন্ধ হচ্ছে না পুলিশের বিতর্কিত সোর্স কালচার। এতে ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে এ বাহিনীর। উপর মহল থেকে বারবার এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেয়ার পরও কিছু অসাধু পুলিশ সদস্যের সোর্স নির্ভরতার সুযোগ নিচ্ছে সোর্সরা। তারা পুলিশের নাম ভাঙ্গিয়ে করছে মাদক ব্যবসা- এমনকি চাঁদাবাজি। অপরাধীদের ধরিয়ে দিয়ে সহযোগিতার পরিবর্তে উদ্ধারকৃত মাদক পুনরায় বিক্রি করছেন তারাই।

জানা যায়, গত কয়েক বছরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ৮ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনারসহ (ডিসি) সংশ্লিষ্টদের বেশ কয়েকবার চিঠি দেয়া হয়, তথাকথিত সোর্স কালচার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। বিভিন্ন থানায় ডিসিরা কঠোর নির্দেশও দেন এ বিষয়ে।

সম্প্রতি গত ২১ জুলাই রাতে বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় সামশুল আলম ও লিপন মিয়া নামে দুই ব্যক্তির পকেটে ৩৫ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট ঢুকিয়ে তাদের মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন দুই সোর্স সেলিম ও বিপ্লব। এ সময় উপস্থিত পুলিশের এসআই শুভঙ্কর রায় ও এএসআই এনামুল হক তাদের দুজনকে বাড্ডা থানায় নিয়ে যান। সামশুল আলম ও লিপন মিয়া পুলিশকে বোঝানোর চেষ্টা করেন তাদের পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপকমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তীর নির্দেশে বিষয়টি তদন্ত করা হয়। নিরপেক্ষ তদন্তে দুজন মাদক ব্যবসায়ী নন বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়। পরে পুলিশ ওই দুই সোর্সের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। দুই দারোগাকে এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে ক্লোজ করা হয়।

গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যার আগে বগুড়ায় পুলিশের সোর্স সোবাহান তার সহযোগীদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা রোকনুজ্জামান রনিকে (৩৩) বাড়ির সামনে এসে ফোনে ডেকে নেয়। এরপর বাড়ির সামনেই রনিকে ছুরিকাঘাত করে। পরে ২৬জুলাই দিবাগত রাত দুইটার দিকে বগুড়া জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। রনি বগুড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন। তিনি বগুড়া শহরের মালগ্রাম এলাকার শাহাদৎ হোসেন সাজুর ছেলে।

ডিএমপির মিরপুর থানার সোর্স চোরা সুজন নিজেকে এসআই দাবি করে বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজী করছেন। ভাষানটেক ও কাফরুল থানার পুলিশ সোর্স শাওনের বিরুদ্ধেও রয়েছে একই অভিযোগ।

চাঁদা না পেয়ে অনেককে মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার অভিযোগ আছে ভাষানটেক থানার সোর্স সুমন মিয়ার (৩৫) বিরুদ্ধে। এছাড়া ভাষানটেক, কচুক্ষেতের মাদক সম্রাট ইমু, মাহমুদা আক্তার ও সুজন ইয়াবা ব্যবসা করছে নির্বিঘ্নে। তাদের সহযোগিতা করছে সোর্স শাওন ও চোরা সুজন।

রাজধানীর কদমতলী-শ্যামপুর এলাকায় টাক্কু রশিদের সোর্স হিসেবে রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। তিনি নিজেকে র‌্যাব-পুলিশ-ডিবির সোর্স পরিচয় দেন। তার বিরুদ্ধে মাদক বিক্রি ও জুয়ার বোর্ড চালানোসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে।

তার শ্যালিকা পাগলি ওয়াসা রোডের বৌ-বাজার রেললাইনে হেরোইন বিক্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত। কদমতলী থানাধীন ওয়াসা এলাকায় সোর্স ইউনুস মাদক বিক্রেতা বিল্লালের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। চোরাই মোবাইল ফোনের ব্যবসা করেন আকবর ফর্মা। এক সময়ের টোকাই কামাল এখন পুলিশের সোর্স হিসেবে এলাকার সাধারণ মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করছেন। কদমতলী থানা এলাকার মুরাদপুর এলাকার সোর্স কামাল ও সোহেলের মাদক ব্যবসার নেপথ্যে রয়েছেন স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতা ও তার ভাগ্নে।

বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় র‌্যাবের সোর্স হিসেবে পরিচিত আলম। রেললাইন এবং ট্রেন কেন্দ্রিক বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে আলমের সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে। চলন্ত ট্রেনে ছিনতাই করে যাত্রীকে ফেলে দেয়ার একটি ঘটনায় কারাগারে ছিলেন আলম।

সূত্র জানায়, লালবাগ থানার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি সোর্স অসীম ও তার সহযোগীরা হাজারীবাগ এলাকার সুইপার কলোনিতে মাদক ব্যবসা করছেন। অপরদিকে লালবাগ থানার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সাহাবুদ্দিন ওরফে বুদ্দিন বর্তমানে মতিঝিল ও সূত্রাপুর থানার সোর্স বলে নিজেকে পরিচয় দেন। ১৯৯৮ সালে ভ্যান রফিক হত্যাকাণ্ডের আসামি সাহাবুদ্দিন। শাহবাগ থানায় তার বিরুদ্ধে দু’টি মাদক মামলা রয়েছে। লালবাগের বেড়িবাঁধ এলাকার জামাই ইদ্রিস অপহরণ মামলার এজাহারভুক্ত আসামি তিনি। তার দ্বিতীয় স্ত্রী সাহিদা নিউমার্কেট থানার তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী।

খিলগাঁও থানা পুলিশের সোর্স ওহাব গোরান এলাকার ছাপড়া মসজিদের পাশে আদর্শবাগের গলিতে ইয়াবা ও ফেনসিডিল ব্যবসা চালান।

কামরাঙ্গীরচর এলাকায় পুলিশ সোর্স আজমল প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা চালাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা ও মাদক মামলা রয়েছে। ২০০৯ সালে নিউ পল্টন জুয়েলারি দোকানে ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে পুলিশ সোর্সের খাতায় নাম লেখান তিনি।

শাহ আলী ও দারুস সালাম থানা পুলিশের এক সোর্সের স্ত্রীও বড় মাপের মাদক ব্যবসায়ী। নাজু নামের ওই মাদক সম্রাজ্ঞী মিরপুরের দিয়াবাড়ি বটতলা এলাকায় ব্যবসা করছেন।

সোর্সের দৌরাত্ম এতই বেশি যে, গত ২০১৬ সালের ৩ ফ্রেব্রুয়ারি রাজধানীর শাহআলীতে চাঁদার দাবিতে প্রতিদ্বন্দ্বী মাদক বিক্রেতা (চায়ের ব্যবসার আড়ালে) বাবুল মাতুব্বরকে পুলিশের সামনেই পুড়িয়ে মারে পুলিশের সোর্স দেলোয়ার, আয়ুব আলী ও রবিনসহ কয়েকজন। এ ঘটনায় ৫ পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়। প্রত্যাহার করা হয় থানার ওসিকেও।

পরবর্তীতে বাবুলের ছেলে রাজু জানান, সোর্স দেলোয়ারের হাতে সবসময় হাতকড়া দেখে তারা সবাই তাকে পুলিশই ভাবতেন।

কড়াইল বস্তিতে পাইকারি মাদক সরবরাহের আরেক মহারাজ হয়ে উঠেছে বনানী থানা পুলিশের ড্রাইভার ও কথিত সোর্স শহীদ। ২০০৫ সালে বিস্ফোরক ও অস্ত্রসহ বনানীর হিন্দুপাড়া বস্তি থেকে গ্রেফতার হওয়া শহীদ পুলিশের সোর্স পরিচয়ে সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছেন। এর আগে শহীদ গুলশান থানার সোর্স ও এসআই সোহেল রানার ড্রাইভার থাকাকালেই কড়াইল বস্তির একাংশ নিজের দখলে নেন। সেখানেই এখন গড়ে উঠেছে তার অপ্রতিরোধ্য মাদক সাম্রাজ্য। ঢাকা উওর সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের বেশ কিছু মাদক স্পট এবং মাদক ব্যবসায়ী থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে শহীদ। যারা চাঁদা দেয় না তাদের পুলিশে ধরিয়ে দিয়ে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

অপরদিকে ভ্রাম্যমাণ ইয়াবা ব্যবসায়ী মহাখালী ওয়্যারলেছ গেইটে ২০নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় সংলগ্ন জ-১৬৭ বুলুর বাড়ীর গাড়ি চালক বনানী থানা পুলিশের সোর্স কাশেম। কৌশলে ড্রাইভারের ছদ্দবেশে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে কড়াইল বস্তিসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা ব্যবসা করেন তিনি।

এ ছাড়া বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তালিকাভুক্ত তথাকথিত মাদক ব্যবসায়ী সোর্সের মধ্যে রয়েছে- গুলশানের নাদিম ও ফর্মা স্বপন, বনানীর নাটা ইউসুফ, রকি ও শরীফ, ধানমন্ডি-কলাবাগানের মিন্টু, নাজির, ফাতেমা ও লাল চান, শাহবাগের ফর্মা কাদের।

নিউমার্কেট এলাকার নাদিম ও কাইল্যা বাবু, মোহাম্মদপুরের হানিফ,রাসেল ও জয়নাল, রমনা এলাকার হেরোইনচি স্বপন, মালেক, খলিল ও আক্তার, সবুজবাগে বজলু মিয়া।

কাফরুলের বাবু, সুমন, মোশারফ, শাহীন, খ্রিস্টান বাবু ও আলমগীর, মিরপুরের সাইফুল, দেলোয়ার, তারেক, রাজু ও রহমান, পল্টনের মরিয়ম, আজমল ও খলিল।

ডেমরার বাবু সেলিম, যাত্রাবাড়ীর শাহিন শাহে আলম, আলতাফ, মাসুম, সুমন, সালাম ও ফর্মা সিরাজ, শ্যামপুর, কদমতলী ও গেন্ডারিয়া এলাকার সোহাগ, আমির, সোহেল, শিপন, জাহাঙ্গীর,ভাগিনা রবিন, নজরুল, লালু, রহিম ও আলী।

কামরাঙ্গীরচর এলাকার মাদক মামলার আসামি সিডি মিন্টু, সোহেল, আরিফ ও আশরাফ, হাজারীবাগের জসিম, রনি, শাহজাহান ও ওয়াসিম, পুরান ঢাকার ইয়াবা ঝিলু, ফেন্সি রমজান, জামান, মনোয়ারা, সেলিম, লিটন,কানাই, সামসু, জাহাঙ্গীর, শাকিল, সাব্বির,বাবলু, সফিক, সুজন ও মাসুদ।

এক সোর্স বলেন, আমরা পুলিশ না, কিন্তু সব সময় পুলিশের সঙ্গে থাকার কারণে এবং পুলিশকে ফোন করলেই চলে আসে বলে স্থানীয় জনসাধারণ বিশ্বাস করে আমরাও পুলিশ।

সোর্সদের নিয়ে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কঠোর নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে বিতর্কিত সোর্সদের নিয়ন্ত্রনে পুলিশের নীরব ভূমিকা নানান ভাবনার জন্ম দিচ্ছে সাধারন মানুষের মনে।

এসব বিষয়ে ডিএমপির শাহ আলী থানার ওসি মো. সালাউদ্দিন মিয়া বলেন, সোর্সরা পুলিশের নাম ভাঙ্গিয়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে যায় বলে শোনা যায়। আইনে সোর্সের বিষয়ে বলা আছে। নির্দিষ্ট কিছু ঘটনায় গুপ্তচর নিয়োগের বিধান রয়েছে। তবে সোর্স যদি পরিচয়ই দেয় তাহলে সে সোর্স রইলো কিভাবে। সোর্স তার পরিচয় প্রকাশ করলে তথ্য পাবে কিভাবে। কেউ কি সোর্সের পরিচয় উল্লেখ করে? সাক্ষ্য আইনের ১২৫ ধারায়ও এ বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। তবে আমার এলাকায় এমন কেউ নেই।

তিনি আরো বলেন, অপরাধী সে যেই হোক তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।

 

রুহুল আমিন