পর্বতারোহী রেশমা নাহার রত্নাকে চাপা দেওয়া সেই মাইক্রোবাসটি (ঢাকা মেট্রো চ ১৫-৩৬৮৫) জব্দ ও এর চালক নাঈমকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার (১৮ আগস্ট) রাজধানীর কাফরুলের ইব্রাহিমপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে গাড়ি জব্দ ও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে ১২ দিনে বিভিন্ন সড়কের ৩৮২টি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে গাড়িটির অবস্থান শনাক্ত করেন তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রত্নাকে চাপা দেওয়ার কথা স্বীকার করেছে নাঈম।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ বলেন, ঘটনার পর কালো রঙের মাইক্রোবাসটির যাত্রাপথ শনাক্তে পুলিশের একাধিক দল কাজ শুরু করে। প্রথমে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহের জন্য শেরেবাংলা নগর ও তেজগাঁও থানার তিন এসআইয়ের নেতৃত্বে তিনটি দল গঠন করা হয়। বিভিন্ন সড়ক, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক স্থাপনার প্রবেশপথে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেন তারা। সেগুলো পর্যালোচনায় জানা যায় মাইক্রোবাসটির গতিপথ। ক্যামেরায় ১২ আসনের হায়েস মাইক্রোবাসটির নম্বরপ্লেটের কিছু অস্পষ্ট ছবি পাওয়া যায়। ফলে নম্বরের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ১১২টি মাইক্রোবাসের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সমন্বয়ে পুলিশের চারটি দল বিআরটিএসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে গাড়ির মালিকানা, রং, আসনসংখ্যা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে। দীর্ঘ প্রচেষ্টায় অবশেষে সাফল্য আসে। মঙ্গলবার দুপুরে ইব্রাহিমপুর থেকে গাড়িটি জব্দ ও চালককে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়।

উপকমিশনার আরো জানান, মাইক্রোবাসটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে মাসিক চুক্তিতে ভাড়া দেওয়া ছিল। ঘটনার দিন প্রতিষ্ঠানের নাইট শিফটের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন গন্তব্যে নামিয়ে দেওয়ার উদ্দেশে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনাটি ঘটে। তখন গাড়ি চালাচ্ছিল নাঈম। বুধবার তাকে আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে।

এ-সংক্রান্ত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেরেবাংলা নগর থানার এসআই মোবারক আলী জানান, আজিমুজ্জামান নামে এক ব্যক্তি মাইক্রোবাসটির মালিক। তার আরও মাইক্রোবাস ভাড়া দেওয়া আছে। তিনি একসময় মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন। বর্তমানে পরিবারের সঙ্গে কাফরুলের ইব্রাহিমপুরে থাকেন। তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে। ইব্রাহিমপুরের বাসার অদূরে একটি গ্যারেজে মাইক্রোবাসটি রাখা ছিল। ঘটনার দিন গণভবন সংলগ্ন সড়ক থেকে গাড়িটি গাবতলীর দিকে যায়। পরে সেটি ইব্রাহিমপুরের গ্যারেজে নিয়ে যায় চালক।

গত ৭ অক্টোবর সকাল ৯টায় সাইকেল চালিয়ে রাজধানীর মিরপুরের পাইকপাড়ায় সরকারি কোয়ার্টারের বাসায় ফেরার পথে গাড়ির চাপায় নিহত হন রত্না। সংসদ ভবন ও চন্দ্রিমা উদ্যানের মাঝের রাস্তা ধরে এগোচ্ছিলেন তিনি। চন্দ্রিমা উদ্যানে প্রবেশের সেতুর কাছে পৌঁছানোর পরই একটা গাড়ি তাকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর রত্নাকে গুরুতর আহত অবস্থায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানকার চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় রত্নার ভগ্নিপতি মনিরুজ্জামান বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামির বিরুদ্ধে মামলা করেন।

পেশায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ৩৩ বছর বয়সী রত্নার স্বপ্ন ছিল হিমালয় পর্বতমালার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট জয় করা। সেই লক্ষ্যে তিনি নিজেকে একটু একটু করে তৈরি করছিলেন। দেশ-বিদেশের কয়েকটি পর্বতের চূড়ায় তিনি উড়িয়েছেন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা। তিনি সাইকেল চালাতে ভালোবাসতেন। ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। এর মধ্যেই সড়কে ধূলিসাৎ হয় তার স্বপ্ন।

রত্না নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার বীরবিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেনের সন্তান। তিনি লোহাগড়া আদর্শ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ইডেন কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক পাস করেন। পর্বতারোহণের ওপর তিনি ভারতের উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশিতে অবস্থিত নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং থেকে বি.এমসি কোর্সে পড়াশোনা করেন। রত্না দীর্ঘদিন বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রের পাঠচক্রের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। দেশে-বিদেশে বেশ কটি হাফ-ম্যারাথন দৌড়ানোর পর নিজেকে ফুল ম্যারাথনে দৌড়ানোর জন্য প্রস্তুত করছিলেন।