কক্সবাজারের টেকনাফে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার তদন্তে বেরিয়ে আসছে নতুন নতুন তথ্য। মামলার প্রধান তিন আসামি বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার, বাহাড়ছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত ও এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত জিজ্ঞাসাবাদে একেক সময়ে একেক রকম তথ্য দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, তদন্ত কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদে নিশ্চিত হয়েছেন, বাহাড়ছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত এসআই নন্দদুলাল রক্ষিতের পিস্তল দিয়ে সিনহাকে গুলি করেছেন। তার কাছে পিস্তল এবং পিস্তলে গুলি থাকা সত্ত্বেও কেন তিনি নন্দদুলালের পিস্তল দিয়ে গুলি করলেন তা তদন্তকারী কর্মকর্তারা যাচাই-বাছাই করছেন। আদালতের নির্দেশে পিস্তলটি জব্দ করেছে র‌্যাব। তদন্ত কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, নন্দদুলালের পিস্তল দিয়ে সিনহাকে গুলি করে পরিদর্শক নন্দদুলালকে ফাঁসাতে চেয়েছেন বা নিজে দায় এড়াতে চেয়েছেন। এ বিষয়টি নন্দদুলালকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি নিশ্চুপ থাকছেন।

ঘটনার দিন রাত ৮টার দিকে থানা থেকে ডিউটি শেষে ভাড়া বাসায় যান নন্দদুলাল রক্ষিত। এ সময় লিয়াকত তাকে ফোন দিয়ে জানান, শ্যামলাপুর চেকপোস্টে ডাকাতের একটি দলকে আটকাতে হবে। লুইন্যা পাহাড়ে তারা আনাগোনা করছে। সেখানকার তিন সোর্সের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তিনি যেন দ্রুত আসেন। এরপর চেইন অব কমান্ড রক্ষা করার জন্য নন্দদুলাল রক্ষিত লিয়াকতের কাছে যান। লিয়াকত দাবি করেছেন, পুলিশের তিন সোর্স যখন তাকে ডাকাতের তথ্য মোবাইলে দেয় এরপর তিনি শ্যামলাপুর চেকপোস্টে গিয়ে হাজির হন।

ওই চেকপোস্টে ২টি ড্রাম দিয়ে অবরোধ বসানো হয়েছিল। এ সময় তিনি সেখানে গিয়ে আরো বড় বসার লম্বা টুল দিয়ে ব্যারিকেডকে আরো শক্ত করেন।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া বিষয়গুলো তদন্তাধীন আছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, গুলি করার বিষয়ে লিয়াকত একাধিকবার একেক রকম তথ্য দিচ্ছেন। ডাকাতরা তাকে গুলি করতে পারে এই ভেবে তিনি আগাম গুলি করেছেন। আবার বলছেন, আগে থেকেই অস্ত্র তাক করে রেখেছিলেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা তার কাছে জানতে চেয়েছেন যে দামি গাড়িতে কোনো ডাকাত চলাফেরা করে কি-না? তিনি এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি।

সূত্র জানায়, ঘটনার দিন রাত ৯টা ৩১ মিনিটের দিকে শ্যামলাপুর চেকপোস্টে ওই ঘটনা ঘটে। ঘটনার পরই লিয়াকত ওসি প্রদীপকে ফোন দিয়েছেন। ১০টা ৭ মিনিটে সেখানে যান টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা আসামিদের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, সিনহা সড়কে কাতরানো অবস্থায় পড়ে থাকলেও কেন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো না, এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তারা। এদিকে সাত দিনের রিমান্ড শেষে সোমবার (২৪ আগস্ট) বেলা তিনটার দিকে র‌্যাব-১৫ এর কার্যালয় থেকে জেলা সিনিয়র জুডিশিয়াল মেজিস্ট্রেট আদালতে নেয়া হলে টেকনাফের বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ, ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দদুলাল রক্ষিতসহ সাত আসামির দ্বিতীয় দফায় চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

গত ৬ আগস্ট সিনহা হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তার ১০ দিনের রিমান্ড আবেদনের শুনানি শেষে কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ তাদের সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

ওই তিন আসামিকে গত ১৮ আগস্ট কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে সাতদিনের রিমান্ডে র‍্যাবের হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। কারাগার থেকে প্রথমে তাদের কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে প্রত্যেকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়। পরে নিয়ে যাওয়া হয় র‍্যাব কার্যালয়ে। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে মামলার মূল তিন আসামিকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যায় তদন্ত সংস্থা র‍্যাব। রিমান্ডে তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে বলে সংবাদ সম্মেলন জানিয়েছিলেন র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ।

এদিকে এ মামলায় রিমান্ড চলমান রয়েছে কক্সবাজারে কর্মরত এপিবিএন-১৪ এর সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) শাহজাহান, কনস্টেবল রাজীব ও আবদুল্লাহর।

প্রসঙ্গত, গত ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের মারিশবুনিয়া পাহাড়ে ভিডিওচিত্র ধারণ করে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকার নীলিমা রিসোর্টে ফেরার পথে শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ। পুলিশ সিনহার সঙ্গে থাকা সিফাতকে আটক করে কারাগারে পাঠায়। পরে রিসোর্ট থেকে শিপ্রাকে আটক করা হয়। দুজনই বর্তমানে জামিনে মুক্ত রয়েছেন।

৫ আগস্ট টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহত সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। পরদিন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন ওসি প্রদীপসহ সাত আসামি।