সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় রিমান্ডে থাকা অভিযুক্ত আসামি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) শাহাজাহান ও কনস্টেবল সজীব আদালতের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার (২৭ আগস্ট) কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম (টেকনাফ-৩) তামান্না ফারাহ’র খাস কামরায় জবানবন্দি দেন এই দুই এপিবিএন সদস্য।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বেলা দেড়টার দিকে তদন্ত সংস্থার সদস্যরা এপিবিএন-এর এএসআই শাহজাহান ও কনস্টেবল রাজীবকে কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে হাজির করেন। সেখানেই বেলা ২টা থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়। জবানবন্দি শেষে বিকেল সাড়ে ৫টায় ওই দুজনকে জেলা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় বলে আদালতের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। তবে এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের সঙ্গে কেউ কোনো কথা বলেননি।
এর আগে বুধবার একই আদালতে র‌্যাবের হেফাজতে সাত দিনের রিমান্ডে থাকা অপর অভিযুক্ত আসামি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) কনস্টেবল আবদুল্লাহ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আবদুল্লাহ জবানবন্দিতে বলেন- গত ৩১শে জুলাই রাতে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান যখন পুলিশের গুলিতে নিহত হন তখন আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম। ওই সময় আমি এপিবিএনের চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় ছিলাম। রাত আনুমানিক সোয়া ৯টার দিকে টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলী এবং এসআই নন্দলালসহ পুলিশ সদস্যরা চেকপোস্টে উপস্থিত হয়ে যানবাহনে তল্লাশী শুরু করেন। একপর্যায়ে একটি প্রাইভেটকারকে থামানোর জন্য এপিবিএনের কনস্টেবল রাজিব সিগন্যাল দেন। পাশাপাশি পরিদর্শক লিয়াকত আলী তার সঙ্গীয় অফিসার ও ফোর্সের সহায়তায় চেকপোস্টের ব্লক দিয়ে ওই গাড়িটির গতিরোধ করেন। তারা গাড়ির আরোহীদের দুই হাত উঁচু করে বের হয়ে আসার জন্য বলেন। প্রথমে গাড়িতে থাকা সিনহার সহকর্মী সিফাত দুই হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নেমে আসেন। সঙ্গে সঙ্গেই এপিবিএনের এসআই শাহজাহান তাকে হেফাজতে নেন। পরে ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা সিনহা নিজের পরিচয় দিয়ে গাড়ি থেকে নামেন। এরপর পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী মুহূর্তের মধ্যেই চার রাউন্ড গুলি করেন। গুলিগুলো ওই ব্যক্তির গলার নিচে, বুকের বাম পাঁজরে প্রায় একই জায়গায় বিদ্ধ হয়। এতে সিনহা আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমারকে অবহিত করেন। পরে আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসার জন্য দ্রুত কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

গত ১৭ আগস্ট জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র‌্যাবের একটি দল এপিবিএনের তিনজনকে হেফাজতে নেন। এরপর ১৮ আগস্ট বেলা সাড়ে ১২টায় তাদেরকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তোলা হয়। ওইদিন র‌্যাবের তদন্তকারি কর্মকর্তা ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানালে কক্সবাজারের জ‌্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহ’র আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গত ২২ আগস্ট তাদের র‌্যাব হেফাজতে নেওয়া হয়।

এদিকে সিনহা হত্যা মামলার অন্যতম আসামি বরখাস্ত ওসি প্রদীপসহ সাত পুলিশ সদস্যের পুনরায় ৪ দিনের রিমান্ড চলছে র‌্যাব-১৫ এর কার্যালয়ে। কক্সবাজারের র‌্যাব-১৫ কার্যালয়ের মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার (২৪শে আগস্ট) বিকালে দ্বিতীয় দফায় তাদের রিমান্ড মঞ্জুর করেন কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালত।

ওই দিন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ৭ পুলিশের মধ্যে বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র‌্যাব-১৫ কার্যালয়ে নিয়ে যান। বাকি ৪ পুলিশ সদস্য- এএসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আবদুল্লাহ আল মামুনকে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।

৩১শে জুলাই রাতে টেকনাফের মারিশবুনিয়া পাহাড়ে ভিডিওচিত্র ধারণ করে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকার নীলিমা রিসোর্টে ফেরার পথে শামলাপুর ১৬ এপিবিএনের তল্লাশী চৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা। এ সময় পুলিশ সিনহার সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে আটক করে। পরে নীলিমা রিসোর্ট থেকে শিপ্রা দেবনাথকে আটক করা হয়। একপর্যায়ে পৃথক মামলায় দু’জনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। বর্তমানে তারা দু’জনই জামিনে মুক্ত রয়েছেন।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যার ঘটনায় ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পরিদর্শক লিয়াকত আলী, ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।

এ মামলায় বর্তমানে টেকনাফ থানার ৭ পুলিশ, পুলিশের মামলার ৩ সাক্ষী ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (১৬-এপিবিএন) তিন পুলিশ সদস্যসহ ১৩ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। পাশাপাশি ১৩ জনের মধ্যে এপিবিএনের ৩ পুলিশ সদস্য ৭ দিন করে রিমান্ড ভোগ করলেও বাকি ৭ পুলিশ ও ৩ পুলিশের মামলার সাক্ষী ১১ দিন করে রিমান্ডে রয়েছেন।