শুধু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) বাসভবনে নয়, পুরো উপজেলা কমপ্লেক্সেই সরকারিভাবে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।সচিবালয়ে মঙ্গলবার আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে এই কমিটির সভাপতি মুক্তিযৃদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান।তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আপনারা দেখেছেন ইউএনওদের নিরাপত্তায় পুলিশ মোতায়েন করেছি। এখন আমরা সংশোধন করে বলেছি, সেখানে আরও অনেক অফিসাররা থাকেন। তাই পুরো উপজেলা কমপ্লেক্স সিসিটিভির আওতায় এনে সারা রাত পাহারা থাকবে, যাতে কোনো ক্রিমিনাল অন্যায়ভাবে কারও ওপর হামলা করতে না পারে।

উপজেলা কমপ্লেক্সে ইউএনও ছাড়াও অধিকাংশ কর্মকর্তা পরিবার নিয়ে বসবাস করেন জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, সবগুলো পরিবার যাতে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বোধ করেন, যাতে আক্রমণের শিকার না হন এজন্য পুরো কমপ্লেক্সকে পাহারার আওতায় আনা হবে।

গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা পরিষদ ক্যাম্পাসে ভেন্টিলেটর দিয়ে বাসায় ঢুকে ইউএনও ওয়াহিদা খানম এবং তার বাবা ওমর আলীর ওপর হামলা চালানো হয়। এরপর সরকার ইউএনওদের সরকারি বাসভবনে আনসার সদস্য নিয়োগ দেয়।চুরি করতে গিয়ে ওয়াহিদার ওপর হামলা হয়েছে বলে বলা হলেও মানুষের কাছে তা খুব বিশ্বাসযোগ্য হয়নি বলে জানান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী। তিনি বলেন, ওয়াহিদার ওপর হামলার ঘটনা আরও তদন্তের জন্য গোয়েন্দা সংস্থাকে আমরা নির্দেশ দিয়েছি। এর পেছনে কী রহস্য আছে, গডফাদাররা কারা, সেগুলো দেখার জন্য বলা হয়েছে।আমাদের দেশে প্রচলিত আইনে কেউ যদি অন্যায় করে তার বিরুদ্ধে প্রতিকার চাওয়ার জায়গা আছে। কারও যদি অভিযোগ থাকে রাতে হামলা করাৃএতে সরকারি কর্মচারীরা কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে, ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে যাবে। কাজেই আমরা তাদের নিরাপত্তার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

ওয়াহিদার ওপর হামলায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ একজনকে আটক করলেও স্থানীয় একজন সংসদ সদস্য প্রভাব খাটিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন বলে একজন সাংবাদিক মন্ত্রীকে জানান।এর জবাবে মোজাম্মেল হক বলেন, কেউ আমরা আইনের ঊর্ধ্বে নই। যাকে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে, তার সম্পৃক্ততা গোয়েন্দা সংস্থা খতিয়ে দেখছে। তার যদি সম্পৃক্ততা থাকে এবং তাকে প্রভাব খাটিয়ে ছাড় করিয়ে নেওয়ার জন্য যদি এমপির সম্পৃক্ততা থাকে তবে তিনিও আইনের ঊর্ধ্বে থাকবেন না।

বাংলাদেশে মাদক কারবারে যে বিপুল অর্থের লেনদেন হয়, তা দিয়ে সমাজের নেতৃত্বদাতাদের অনেককে কিনে ফেলা হয় বলে মনে করেন বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।সেই উপলব্ধি থেকে মাদক কারবারিদের পাশাপাশি তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদেরও শনাক্ত করতে গোয়েন্দাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।মোজাম্মেল সাংবাদিকদের বলেন, মাদক যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে আছে, তারপরেও আরও উন্নত করতে চাই। বাংলাদেশের বিশাল বর্ডার, অনেক দুর্গম জায়গাও আছে। সেখান দিয়ে ক্রিমিনালরা সহজেই ঢুকে এবং মাদক ব্যবসায়ীদের সাথেৃ।

আমাদের ধারণা যে ১০/২০ টাকার মাদকের ট্যাবলেট ৩০০-৪০০ টাকা করে বিক্রি করে, সেজন্য অনেকের মাথা কিনে ফেলে। যারা সমাজের নেতৃত্ব করি তারাও ইনভলভ হয়ে যাচ্ছে, যারা মাদকসেবী তারা তো আছেই। এছাড়া উচ্চ পর্যায়ের লোকেরাও, বড় বড় ব্যবসায়ীরা।মাদকদ্রব্য বেচাকেনা করে সহজে অর্থ রোজগার করা যায় বলে অনেকেই এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন বলে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী।

তিনি বলেন, আমরা এখন সব থেকে গুরুত্ব দেব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, (মাদক) আনা-নেওয়া করে শুধু তারা না, তাদের যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় সেগুলো গোয়েন্দা সংস্থাকে বলা হয়েছে আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতাদের আইডেন্টিফাই করে হাত দিতে হবে।মাদকের দৌরাত্ম্য কমাতে বছর দুয়েক ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান কথিত বন্দুকযুদ্ধে সন্দেহভাজন অনেক মাদক কারবারি নিহত হয়েছেন। তারপরেও দেশে মাদকের কারবার চলছে।মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে মাদক নিয়ন্ত্রণে রাখতে আরও বেশি মাদকবিরোধী অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী মোজাম্মেল।

তিনি বলেন, যারা মাদক চালানের সাথে জড়িত তাদের শাস্তি যেন দৃশ্যমাণ হয় সেজন্য আগের আইনের দুর্বলতা কাটিয়ে আইনকে আপডেট করার ব্যবস্থা নিচ্ছি।করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ছোট ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারছেন না জানিয়ে মোজাম্মেল হক বলেন, নিম্ন আয়ের লোকদের আয় বন্ধ হয়ে গেছে, আর্থিক সংকটে সারা জাতি আছে।এ অবস্থায়ও আমরা অত্যন্ত সন্তুষ্ট আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আছে এবং যেহেতু মানুষের আয় রোজগারের পথ কমে গেছে কাজেই ওই লোকজন হয়ত ক্রাইমের দিকে যাবে, কিন্তু সেটা আল্লাহর মেহেরবাণীতে, প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে বলে আমরা মনে করি।

এনজিওর ব্যানারে কিছু কিছু সংস্থা রোহিঙ্গাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে অভিযোগ করে আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভাপতি মোজাম্মেল জানান, রোহিঙ্গাদের কর্মকা- আরও বেশি করে তদারকির ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে সরকার।রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সেখানে কিছু আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতা আছে এনজিওদের নামে যাতে রোহিঙ্গারা বিভিন্নভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে মারামারি, কাটাকাটি বা মাদকদ্রব্য ও ক্রাইমের সাথে জাড়িত হচ্ছে সেগুলোও নিয়ন্ত্রণের জন্যৃ ২৪টি টাওয়ার নির্মাণ করে সেখান থেকে যেন সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করতে পারি।
প্রয়োজনীয় সংখ্যক সিসি ক্যামেরা দিয়ে তাদের কার্যক্রম মনিটর করা হবে। ক্রাইমের সঙ্গে অল্প সংখ্যক জড়িত। কেউ কেউ মাদক পাচারেও জড়িত হয়ে যায়, বাউন্ডারি ওয়াল না থাকায় নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।এক প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের কারা পৃষ্ঠপোষকতা করছে তা আরও সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে বলা হয়েছে। তারা কী অন্যায় কাজ করছে, কী খারাপ কাজ করছে সেটা দিতে বলেছি।দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যেসব কাজ করছে সেগুলো সমন্বয়ের জন্য একটি কমিটি করবে সরকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে সেই কমিটি করার দায়িত্ব দিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।

মোজাম্মেল বলেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজের সমন্বয়ের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে। এজন্য বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে একই আমব্রেলার নিচে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই কমিটি করা হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন এলে তারা কম্পাইল করবে।রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণায় লিপ্ত থাকা ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে কারা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে এবং কীভাবে সেই বিজ্ঞাপনের বিল পরিশোধ করা হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে এনবিআরকে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রিসভা কমিটি।

মন্ত্রী মোজাম্মেল বলেন, আপনারা নিশ্চয় লক্ষ করেছেন ইউটিউব, ফেইসবুকে কিছু কিছু চ্যানেল বের হয়েছে, এসবের মাধ্যমে শুধু সরকারবিরোধী নয়, সরকারের বিরুদ্ধে বলার তো আপনার অধিকার আছে। তাদের বক্তব্য রাষ্ট্রবিরোধী।যারা এসব সংবাদ প্রচার করে সেখানে অনেক বিজ্ঞাপন আছে, টাকার উৎস কী, সেটা কারা দেয় এবং কিভাবে এই বিজ্ঞাপন দেয়, দেশে পেমেন্ট হয় নাকি বিদেশে হয়, সেগুলো যাচাই করে দেখতে এনবিআরকে বলেছি।বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে, মোবাইল বা অনলাইনে বা অত্যাধুনিক কোনো প্রক্রিয়ায়, সেজন্য এনবিআরকে আমরা অনুরোধ করেছি এই বিজ্ঞাপন দেয় কারা তা খতিয়ে দেখতে।

তিনি বলেন, সরকার প্রেসের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, সাংবাদিকদের পেশাগত স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী উদার। কিন্তু কোনো লাইসেন্স নাই, পারমিশন নেই এ রকম সেগুলোর ব্যাপারে আমরা বিটিআরসিকে অনুরোধ করেছি, যারা এগুলো চালাবে তাদের জবাবদিহি থাকতে হবে।সাইবার অপরাধগুলো এখন খুব অ্যালার্মিং হয়ে গেছে উল্লেখ করে মোজাম্মেল হক বলেন, সাইবার অপরাধ দমনের জন্য গোয়ন্দা তৎপরতা বাড়াতে এবং সোশ্যাল মিডিয়ার হেড কোয়ার্টার এখানে শিফট করার মাধ্যমে মনিটর করব। কোনো কিছু বন্ধ করে দেওয়া হবে না, আমরা বন্ধে করার পক্ষে না। সেগুলোর জবাবদিহি থাকবে. আমরা তার পক্ষে।