কওমি অঙ্গনের সিংহপুরুষ সদ্য প্রয়াত আল্লামা আহমদ শফীর উত্তরসূরি কে হচ্ছেন? যাকে হয়তো একই সঙ্গে আরও তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার দায়িত্ব পালন করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম, বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) এবং আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া। দেশর সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ আলেম আল্লামা শফী মৃত্যুর পর এখন কে বা কারা আসছেন এই তিন প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে সেদিকেই এখন দৃষ্টি সবার।

কার্যত গত শুক্রবার তাঁর মৃত্যুর পর কওমি অঙ্গন ও সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় দায়িত্বশীলদের মাঝে এ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে-কে হবেন এসব প্রতিষ্ঠানের ধারক-আল্লমা শফীর উত্তরসূরি? কওমি নেতৃবৃন্দরা বলছেন, এতদিন হাটহাজারী মাদ্রাসা, বেফাক-হাইয়া ও হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব এককেন্দ্রীক থাকলেও এখন তিনটি আলাদাভাবে পরিচালিত হবে। কারণ আল্লামা শফীর মতো সর্বজনমান্য এমন কেউ নেই, যাকে সবাই একবাক্যে মেনে নেবেন। তাই এসব পদে সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা, রাজনৈতিক কোনো অভিলাষ থাকবে না এমন কাউকে নির্বাচিত করার মত দিলেন কওমি নেতৃবৃন্দরা।
গত শুক্রবার রাতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ সম্পর্কে হেফাজতের মহাসচিব ও হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষা পরিচালক আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেছেন, হেফাজতে ইসলামের পরবর্তী আমীরকে হবেন তা কাউন্সিলের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে। আল্লামা শফীর ইন্তেকালের পর সংগঠনের কার্যক্রমে কোন প্রভাব পড়বে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে বাবুনগরী বলেন, প্রভাব তো কিছু হবেই। ওনার মতো তো আর মানুষ পাওয়া যাবে না। আমার দায়িত্ব হলো এখন কাউন্সিল ডাকা। কাউন্সিল যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই হবে।

আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতে ইসলামের প্রধান বা আমির হিসেবে তিন জনের নাম আলোচনায় আসছে। এরা হলেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, বর্তমান মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী এবং ঢাকা মহানগর আমির মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী। তবে যিনিই এই পদে আসুন না কেন, সিগন্যাল যাবে হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে এমনটি বলছেন সংশ্লিষ্টদের অনেকে।

তবে চট্টগ্রাম অঞ্চলের হেফাজত কর্মীরা মনে করছেন, বর্তমান নায়েবে আমীর আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী বা মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী দুজনের যে কোনো একজনই হবেন হেফাজতের পরবর্তী আমির। তাছাড়া ঢাকা মহানগর হেফাজতের আমির আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীর কথা হাইকমান্ডের অনেকের মুখে থাকলেও কাসেমীর রাজনৈতিক পরিচয় থাকায় শেষ দৌড়ে তিনি টিকতে পারবেন না বলে অনেকের ধারণা। এক্ষেত্রে হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক শেখ আহমদও বিবেচনায় আসতে পারেন বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
এছাড়া কে আসছেন কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এবং সরকার স্বীকৃত সম্মিলিত বোর্ডের প্রধান হিসেবে এ নিয়েও আলোচনা চলছে জোরেসোরেই। একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, ২০০৫ সালে বেফাকের সভাপতি নির্বাচিত হন আহমদ শফী এবং ২০১৭ সালে নির্বাচিত হন আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়ার চেয়ারম্যান। গঠনতান্ত্রিকভাবে বেফাকের চেয়ারম্যান যিনি হবেন তিনিই আল-হাইআতুল উলয়ার চেয়ারম্যান হওয়ার কথা।
তবে বিতর্কিত নানা ভূমিকার কারণে বেফাকের বর্তমান মহাসচিব ও ঢাকার ফরিদাবাদ মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা আবদুল কুদ্দুছের সম্ভাবনা এই তালিকায় দেখছেন না অনেকে। আপাতত আলোচনায় যাদের নাম আসছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন বেফাকের বর্তমান সহ-সভাপতি নূর হোসাইন কাসেমী ও নুরুল ইসলাম, ঢাকার যাত্রাবাড়ি মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহমুদুল হাসানসহ আরও কয়েকজন। এরমধ্যে বেফাকের আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী ও মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস এরা দু’জনই ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে যুক্ত থাকায় তাদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে অনেকের আপত্তি রয়েছে জানা গেছে।

অবশ্য খুব শিগগিরই বেফাক ও হাইয়া কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ের সমাধানে বসবে বলে অনেক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বেশ কওমি আলেম-ওলামা আহমদ শফী বিকল্পহীন নেতা ছিলেন এমনটা স্বীকার করে বলেন, এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে যাকেই মনোনীত করা হোক, আল্লামা শফীর মতো সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা কারও নেই। তিনি এমন সময় কওমি অঙ্গনের হাল ধরেছিলেন যখন পারস্পরিক অনৈক্য, অনাস্থা ও বিভেদের জেরে দেশের মাদ্রাসা শিক্ষায় বিপর্যয় নেমে এসেছিল। ধর্মপ্রাণ মানুষ চরম হতাশায় পড়ে গিয়েছিলেন। তিনি মাঠে এসে শুধু ধর্মপ্রাণ মানুষই নয় বরং দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এক কাতারে নিয়ে আসেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কওমির এক শীর্ষ আলেম বলেন, আল্লামা শফীর পর এখন বেফাক আর হাইয়ার চেয়ারম্যান পদটি খুবই গুরুত্বের দাবি রাখে। এ পদে এমন কাউকে বসাতে হবে, যার সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা থাকবে। তবে যার রাজনৈতিক কোনো অভিলাষ থাকবে না। পাশাপাশি তিনি সব বির্তকের ঊর্ধ্বে থাকবেন এমন কাউকে নির্বাচিত করতে হবে কওমি অঙ্গনের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির জন্য।

এছাড়া সারাদেশে বিস্তৃত এবং আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত সংগঠনের মূল নেতৃত্বে অভিজ্ঞ, দূরদর্শী এবং নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন ব্যক্তি আসা উচিত। তবে তাড়াাহুড়ো না করে একটু ধীরস্থিরে এগোনো প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন। এদিকে গত শনিবার রাতে মজলিসে শূরার জরুরি বৈঠকে জুনায়েদ বাবুনগরী হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রধান শাইখুল হাদিস ও শিক্ষাসচিব হন। ফলে অলিখিতভাবে তিনিই হাটহাজারী ‘বড় মাদ্রাসা’ হিসেবে পরিচিত মাদ্রাসাটির মূল কর্তৃত্বে চলে এলেন। এতে করে মজলিসে শূরার বেধে দেয়া সময় ৬ মাস পর প্রতিষ্ঠানটির মুহতামিম (মহাপরিচালক) হওয়ার পথ অনেকটা সুগম হলো বলে মনে করেন কওমি অঙ্গনের নেতৃবৃন্দরা।

প্রসঙ্গত, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষায় আমূল সংস্কার সাধনসহ কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি আদায়ের মহাপুরুষ প্রয়াত আল্লামা শফি বিগত ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি হাটহাজারী মাদ্রাসা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ গঠিত হয়। তখন এর আমির মনোনীত হন আল্লামা আহমদ শফী। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ওই পদে আসীন ছিলেন।

২০১৩ সালের এপ্রিলে ‘নাস্তিক ব্লগারদেও শাস্তি এবং ইসলাম ধর্মের অবমাননাকারীদের কঠোর শাস্তির বিধানসহ ধর্ম অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদ-ের আইন করার দাবিতে অনুষ্ঠিত লংমার্চ এসে রাজধানীর শাপলা চত্বরে জমায়েত হওয়ার পর ওই প্রথম হেফাজতে ইসলাম দেশব্যাপী নজর কেড়ে নেয়। এরমেধ্যে দেশের ইতিহাসে একই সঙ্গে এতগুলো শীর্ষপদে থেকে সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন করা আল্লামা আহমদ শফী গত শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানী ঢাকার গে-ারিয়ার আজগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন।